গায়ে-গা-ছুঁয়ে: এক দেওয়ালেই দরগা-মন্দির। গোলাপবাগে। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।
মাস আটেক আগে একই দিনে নারকেল ফাটিয়ে শুরু হয়েছিল মন্দির আর দরগার ভিত গড়া। মুর্শিদাবাদ শহরের গোলাপবাগে হিন্দু-মুসলিমের এই যৌথ সংসার।
পোক্ত ভিত কিন্তু আসলে অনেক আগেই গড়া হয়ে গিয়েছিল। সেই ভিতে দাঁড়িয়েই তো ইদগাহে যাওয়া রাস্তা গড়তে জমি দেন হিন্দু দিনমজুর। মুসলমানের জমিতে গড়ে ওঠে মন্দির।
সেই পোক্ত ভিতটা ছিল বলেই পঁচিশ বছর আগে এই দিনটায় দেশের নানা প্রান্তে যখন দাঙ্গার আগুন, হি ন্দুপ্রধান নদিয়া আর মুসলিম অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ সংযত। বর্বরদের হাতে বাবরি মসজিদ ধসে যাওয়ার পরে থমথমে উত্তেজনা ছিল প্রতিটি মহল্লায়। কিন্তু একটিও লাশ পড়েনি। ঘটেনি একটিও অবাঞ্ছিত ঘটনা।
ফেসবুকে একটি কুরুচিকর পোস্ট নিয়ে যখন বসিরহাট উত্তপ্ত, তখনও কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে মন্দির ও দরগা তৈরি করেছেন গোলাপবাগের মানুষ। দরগাটি কয়েকশো বছরের পুরনো। দুর্গাপুজোও হচ্ছে বহু বছর। দু’পক্ষের সুবিধের জন্য যৌথ নির্মাণ। যৌথ কমিটি সভাপতি দরগার মোতোয়ালি মেহেরবান মোল্লা, গোলাপবাগ দুর্গাপুজো কমিটির সম্পাদক অনুপ সাহা। কোনও রকম ভেদাভেদকে তাঁরা আমল দিতে নারাজ।
তেহট্টে টোপলা, প্রতাপনগর আর নাজিরপুরের মুসলমানের যে ইদগাহে ইদের নমাজ পড়েন, সেখানে যাওয়ার সরাসরি রাস্তা ছিল না প্রতাপপুর থেকে। দু’কিলোমিটার ঘুরপথে যেতে হত। রাস্তা গড়তে ১৪ জন জমি দান করেন। তার মধ্যে দু’জন হিন্দু— দুই দিনমজুর বিশ্বজিৎ ও জয়দেব পাল। ইদগাহ কমিটি তাঁদের জমির দাম দিতে চেয়েছিল, তাঁরা রাজি হননি।
ওই তেহট্টেই সিনেমাহল পাড়ায় বিশালাক্ষী মন্দির তৈরির জন্য প্রায় তেরো শতক জমি দিয়েছেন তিন ভাই — ইসমাইল মণ্ডল, আদম মণ্ডল ও হারান আলি মণ্ডল। আগে কুলগাছের নীচে ভাঙাচোরা বেদিতে পুজো হত। ইসমাইলের ছেলে লতিবুদ্দিন বলেন, “ওই জমি আমাদের হলেও ছোটবেলা থেকে ওখানেই পুজো হতে দেখেছি। বড়রা শিখিয়েছেন, সব ধর্মকে ভালবাসলে তবেই নিজের ধর্ম পালন করা হয়।”
নবগ্রামের কিরীটেশ্বরী মন্দিরের জন্যও জমিদান করেছেন মুসলিমেরা। গত মার্চে কান্দি শহরের বিশ্রামতলায় মন্দির গড়ার কাজ শুরু হয়। ফি বছর চৈত্র সংক্রান্তির দিন রূপপুর থেকে রুদ্রদেবের বিগ্রহ হোমতলায় আসে। পথে কিছুক্ষণ বিশ্রাম বিশ্রামতলায়। সেখানে মন্দির গড়তে জমি দিয়েছেন আইনজীবী সফিউর রহমান। নির্মাণ কাজে হাত লাগিয়েছেন আখতার হোসেন, সাইফুর জামানেরা।
গত ইদের দিন করিমপুরের নাটনা গ্রামে ইদগাহের পাশে মন্দিরে সকাল কীর্তন শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু তার খানিক বাদেই যে ইদের নমাজ! দু’পক্ষ বসে সিদ্ধান্ত নেয়, নমাজের সময় খানিক এগিয়ে আনা হবে আর একটু পিছিয়ে দেওয়া হবে কীর্তন। নমাজ মেটে কোলাকুলিতে। তার পর দিনভর কীর্তন আর খিচুড়ি ভোজে মেতে ওঠেন ভবেশ মণ্ডল, গোপাল বিশ্বাস, বদরুদ্দিন শেখ, ইনামুল বিশ্বাসেরা।
দাঙ্গাবাজদের সাধ্য কী যে এই ভিত টলিয়ে দেয়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy