তখনও অন্ধকার কাটেনি। পুবের আকাশ সবে ফিকে। অঘ্রান মাস। হাল্কা ঠান্ডা। ঘাসের মাথায় শিশিরের দানা। গুটিগুটি পায়ে জেলখানার মাঠে ফুটবল প্র্যাকটিস করতে যাচ্ছিল বছর আঠারোর উৎপল মাইতি।
মাঠের পাশে শহিদ বেদির পিছনে কে দাঁড়িয়ে? অনেকেই এ মাঠে হাঁটতে আসে। কিন্তু এ তো নড়ছেও না, চড়ছেও না। বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে উৎপলের। এক পা-দু’পা করে খানিক এগোয় সে... আর এগোতেই হাড় হিম হয়ে যায় তার।
বাঁধানো সাদা বেদির উপরে যত্ন করে রাখা একটা কাটা মুন্ডু। চুল যত্ন করে আঁচড়ানো। বেদির গা বেয়ে রক্ত চুঁইয়ে নেমেছে।
ততক্ষণে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন অঞ্জলিও। সারাটা রাত তিনি ঘর-বার করেছেন। ছেলেটার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, ঘরে এক ফোঁটা ওষুধ নেই। মোটে তো এক বছর বয়স।
রোজ মিষ্টির দোকানে কাজে যাওয়ার সময়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে বড় রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে যেত মানুষটা। পাশে অঞ্জলি। সে দিন আর নেয়নি। বলেছিল, ‘‘জ্বরে কাহিল, জাগিও না, ফিরে এসে না হয় আদর করব।’’
সেই মানুষটা রাতে ফেরেনি।
কোনও দিন তো এমন হয়নি! ভালবেসে ঘর বেঁধেছিল। শ্বশুরবাড়ি মেনে নেয়নি। নতুন বৌকে নিয়ে ঘূর্ণি তরুণ সঙ্ঘের কাছে বাসা ভাড়া করে চলে এসেছিল বছর বাইশের বিদ্যুৎ বৈরাগ্য। তিরিশ টাকা রোজে কাজ নিয়েছিল চাষাপাড়ার মোড়ে মিষ্টির দোকানে। সারা দিনমান কাজ নেই। বৌয়ের আশপাশে ঘুরঘুর করত, ছেলে সামলাত। কাজ সন্ধে সাতটা থেকে রাত বারোটা। পুজো-পার্বণের সময় সারা রাত।
পুজো সবে গিয়েছে। কাজের চাপ নেই। রোজ বিকেলে চা বানিয়ে নিজে খেত বিদ্যুৎ, অঞ্জলিকেও দিত। সে দিন কেন কে জানে বলেছিল, ‘‘একটু চা করে দেবে?’’ অঞ্জলি দিয়েছিল। তেল-ধনেপাতা দিয়ে মুড়িও মেখে দিয়েছিল। পছন্দ ছিল খুব। খেয়ে সেই যে বেরিয়ে গেল, আর তো এল না?
রাত যত বেড়েছে, ছটফটানিও তত বেড়েছে অঞ্জলির। মাঝরাতে এক বার ঘুমন্ত ছেলেকে চৌকিতে শুইয়ে রেখে ‘লম্প’ হাতে রাস্তায় বেরিয়েও পড়েছিলেন। দু’টো কুকুর এমন ভাবে তেড়ে এল যে না ফিরে উপায় ছিল না। কিন্তু চোখে ঘুম নেই।
আঁধার ফিকে হতেই দোরে শিকল তুলে বেরিয়ে পড়েছিলেন অঞ্জলি। কোলে চাদরে জড়ানো দুধের ছেলে। কোথায় যাবেন? মিষ্টির দোকানে গিয়ে খোঁজ নেবেন? পাগলের মতো কৃষ্ণনগর-করিমপুর সড়ক দিয়ে হাঁটছেন, চেনা রিকশাওয়ালা এসে সামনে দাঁড়াল— ‘‘বৌদি রিকশায় উঠুন। পৌঁছে দিচ্ছি।’’ কোথায় নিয়ে যাবে? কিছু জানতে চাইল না তো? ‘‘না গো, আমার কাছে পয়সা নেই’’— কোনও রকমে বললেন অঞ্জলি। ‘‘লাগবে না বৌদি, আপনি উঠুন।’’
জোর করেই মা-ছেলেকে তুলে কৃষ্ণনগরের দিকে এগিয়ে যায় রিকশা। ঘূর্ণির পুতুলপট্টি থেকে মিষ্টির দোকানের রাস্তা ডান দিকে, রিকশাটা বাঁ দিকে যাচ্ছে কেন? মন কু-ডাক দিচ্ছে। এ কি জেলখানার মাঠে এত ভিড় কেন? কী হয়েছে? মাঠের কাছেই দাঁড়িয়ে পড়ে রিকশা। ছেলে কোলে লাফিয়ে নেমে ছুটে যান অঞ্জলি। ভিড়টা দু’পাশে সরে যেতে থাকে। অঞ্জলি পাগলের মতো ছুটে যান বেদির দিকে। থমকে দাঁড়ান। এক ঝলক! তার পর... অন্ধকার। ছেলেটা পড়ে যায় কোল থেকে। অঞ্জলিও পড়ে যান।
কে এমন করে মারল? খুন করে কে আঁচড়ে দিয়ে গেল চুল? কে সে?
এর পরে কয়েকটা দিন অঞ্জলির কেটেছে ঘোরের মধ্যে। কিন্তু গোটা শহর জুড়ে এই একটাই আলোচনা। ক’দিন পরে ধরা পড়ল খুনি। তারও কচি বয়স। পুলিশের খাতায় উনিশ, চেনাশোনা লোকেদের দাবি, আরও বছর দুই কম। নাম কেষ্ট অধিকারী, গুন্ডা-মাস্তানদের সঙ্গেই ওঠাবসা ছিল তার। প্রচুর নেশা করত। সেই রাতেও করেছিল। জেলখানার পাশে জঙ্গলের মধ্যে একটা গর্তে মুন্ডুহীন ধড় সে-ই দেখিয়ে দিল। অঞ্জলি তখনও ছুটতে ছুটতে গিয়েছিলেন। কিন্তু... ‘‘ফরসা করে একটা বাচ্চা পুলিশ অফিসার কিছুতেই আমায় যেতে দিল না। বলল, ‘দেখতে পারবেন না।’ হাতের ডানা দু’টো ধরে আটকে রাখল।’’
বাইশ বছর অনেকটা সময়। কত স্মৃতি ফিকে হয়ে যায়। কত নতুন গল্প তৈরি হয়ে ওঠে। ১৯৯৪ সালের সেই দিনটার পরে কিছু দিন অঞ্জলি আর তাঁর ছেলের খোঁজ রেখেছিল শহর। কোতয়ালি থানার বড়বাবু অঞ্জলির শাড়ির আঁচলে বেঁধে দিয়েছিলেন এক হাজার টাকা। বলেছিলেন, থানায় কাজ জুটিয়ে দেবেন। কিন্তু তিনি বদলি হয়ে গেলেন। পাড়ার ছেলেরা চাঁদা তুলে পাঁচশো টাকা দিয়েছিল। তা-ও শ্রাদ্ধশান্তিতে খরচ হয়ে গেল।
বিয়ের আগে বাসস্ট্যান্ডের কাছে যে বাড়িতে কাজ করতেন, সেখানেই কিছু দিন ঠাঁই হয়েছিল অঞ্জলির। কিন্তু এ ভাবে তো বেশি দিন চলতে পারে না। এক দিন ভাই এসে ফিরিয়ে নিয়ে গেল তাদের কাছে ভীমপুরের পলদা-মুড়াগাছা গ্রামে। কিন্তু খাওয়া জুটবে কী করে? বাবা প্রচণ্ড গরিব। ভাইটাও ছোট। তাদেরই খাওয়া জোটে না সব দিন। মাথার উপরে ঘরের চালটাও নড়বড় করে।
বেঁচে থাকার তাগিদে সেই সময়ে ছেলে কোলে বাড়ি-বাড়ি ভিক্ষেও করেছেন অঞ্জলি। বছর বারো আগে গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে রান্নার বাসন মাজার কাজ পান, মাসে ৩০ টাকায়। অনেকের হাতে-পায়ে ধরে শেষে ওই স্কুলেই রান্নার কাজ মেলে। বেতন বাড়তে বাড়তে এখন মাসে দেড় হাজার। বছর দুই আগে শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি পেয়ে বাপের বাড়ির গ্রামের পাশে পাকুগাছিতে জমি কিনে একটা ছোট্ট টিনের ঘরও তুলে ফেলেছেন। ছেলেটাও বড় হয়ে গিয়েছে। স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন সে বিএ প্রথম বর্ষে। রাজমিস্ত্রির কাজ করে নিজের পড়ার খরচ নিজেই চালায়।
এই করতে-করতেই বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেল অঞ্জলির। বড় বিপদ অবশ্য হানা দিয়েছিল আরও এক বার। বছরখানেক আগে বন্ধুর সঙ্গে শিবনিবাস মেলায় গিয়ে মোটরবাইক দুর্ঘটনায় মরতে বসেছিল জোয়ান ছেলে। হাসপাতালে তিন দিন তার জ্ঞান ফেরেনি। সে ক’দিন শুধু এক মনে ভগবানকে ডেকে গিয়েছেন অঞ্জলি। ‘‘আমার তো আর কেউ নেই দুনিয়ায়। ভগবানই ভরসা।’’
আর কেষ্টর কী হল?
সেই কেষ্ট, যে না কি ধরা পড়ার পরে বলেছিল, ‘আমার রক্ত ভাল লাগে, তাই খুন করেছি!’ কিন্তু ভাল লাগে বলেই খুন করে ফেলল সে? কেষ্টর আইনজীবী অনীল রায় জানান, ওই রাতে কেষ্ট নেশায় চুর হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। মিষ্টির দোকানে কাজ সেরে বিদ্যুৎ ওই রাস্তা ধরেই বাড়ি ফিরছিল। কেষ্ট তার কাছে বিড়ি চায়। বিদ্যুৎ তা জোগাতে পারেনি। আর তার পরেই...
কৃষ্ণনগর আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল কেষ্টকে। কলকাতা হাইকোর্ট থেকে পরে সে জামিন পেয়ে যায়। কৃষ্ণনগরে ফিরে সদর মোড়ের কাছে বাস গুমটিতে কাজ নেয়। বিয়ে করে, ছেলেও হয়। পরে হাইকোর্টও তার সাজা বহাল রাখে। ফের জেলে যায় কেষ্ট। ষষ্ঠিতলার বাড়িতে তার পঁচাত্তরের বৃদ্ধা মা প্রতিমা অধিকারী বলেন, ‘‘ছেলেটা আমার একদম পাল্টে গিয়েছিল, জানেন? জেলেও এত ভাল হয়ে থাকত, যে বাড়িতেও আসতে দিয়েছিল।’’
এর পরে দু’বার দমদম জেল থেকে প্যারোলে বাড়ি আসে কেষ্ট। দ্বিতীয় বার আর ফেরা হয়নি। গত বছর ৪ সেপ্টেম্বর বাইকে চাপড়ার দইয়ের বাজারে দিদির বাড়ি যাওয়ার পথে কৃষ্ণনগরের কাছে পানিনালায় কৃষ্ণনগর-করিমপুর সড়কে বাসের ধাক্কায় সে মারা যায়।
কেষ্ট মারা গিয়েছে জানেন?
মাটির মেঝেয় বসে চোখ তুলে তাকান অঞ্জলি— ‘‘কী করে?’’
—বাসে চাপা পড়ে।
আস্তে আস্তে উঠে অঞ্জলি এগিয়ে যান ঘরের কোণে কুলুঙ্গিটার দিকে। বের করে আনেন প্লাস্টিকে মোড়া মলিন একটা ছবি। আড়াই দশক আগের এক নবদম্পতির। হাসিমাখা দু’টি মুখ।
পরম মমতায় ছবিটায় হাত বুলিয়ে চলেন অঞ্জলি। টপ টপ করে দু’ফোঁটা জল ঝরে পড়ে।
অঙ্কন: অশোক মল্লিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy