নিজের বাড়িতে মায়ের সঙ্গে ভবানী বর্মণ। রবিবার নবদ্বীপে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
কোয়েশ্চেন পেপারটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসেছিলাম।
করবই বা কী? বন্ধুরা পুরো প্রশ্নপত্র না পড়া পর্যন্ত আমার কিছু করার ছিল না। তখন আমি অত ছোট লেখা পড়তে পারি না। ওরা পড়ে আমাকে প্রশ্নগুলো বলবে তবে তো আমার উত্তর লেখার পর্ব।
মিনিট দশেক পর দুই বন্ধু দু’দিক থেকে প্রশ্ন বলে দেওয়া শুরু করতেই ছুটে এলেন যিনি গার্ড দিচ্ছিলেন। কঠোর ভাষায় বললেন, ইতিহাসে এমএ পরীক্ষা দিচ্ছি, এটা যেন মাথায় রাখি। আর একটি কথা বললে হল থেকে বার করে দেবেন।
ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। বুঝতে পারছিলাম না, কী করে স্যরকে বোঝাব যে আমি একটা চোখে দেখতে পাই না, অন্য চোখে ঝাপসা দেখি। ছাপানো প্রশ্ন পড়তে পারব না বলে বন্ধুরা আমাকে প্রশ্ন পড়ে দিচ্ছে, উত্তর বলছে না।
বন্ধুরাই স্যরকে সংক্ষেপে জানাল, আমি লিউকিমিয়ায় আক্রান্ত। আমার চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। স্যর অবাক হয়ে বললেন, “তা হলে লিখবে কী করে?” ছোটবেলার মতো বড় হরফে ফাঁক দিয়ে লেখা রপ্ত করে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। তা শুনে স্যর আর কোনও কথা বলেননি। শুধু আমার মাথায় হাতটা একটু রেখেছিলেন।
আমি নবদ্বীপের মেয়ে। মনে পড়ে ২০১৬-র ফেব্রুয়ারি। সরস্বতী পুজোর দিন বন্ধুদের সঙ্গে শাড়ি পরে ঘুরতে বেরিয়ে শরীর ভাল লাগছিল না। জ্বর এল বিকেলে। পাঁচ দিনের মাথায় এমএ পার্ট ওয়ান পরীক্ষা। প্যারাসিটামল খেয়েও লাভ হয়নি। জ্বর গায়ে প্রথম পরীক্ষা। দূরে সিট পড়েছিল। এত অসুস্থ হয়ে ফিরলাম যে রাতেই ভর্তি হতে হল নবদ্বীপ হাসপাতালে। তখনও তিনটে পরীক্ষা বাকি। তিন দিনের মাথায় ডাক্তারবাবুদের কাছে কান্নাকাটি করে হাসপাতাল থেকে বাড়ি এলাম বটে কিন্ত তৃতীয় পরীক্ষার রাতে ফের যেতে হল হাসপাতালে। শেষ পরীক্ষা নবদ্বীপ স্টেট জেনারেল হাসপাতাল থেকে দিতে গিয়েছিলাম।
তত দিনে কাশির সঙ্গে রক্ত উঠতে শুরু করেছে। কলকাতায় গিয়ে ধরা পড়ল লিউকিমিয়া। হিমোগ্লোবিন হু হু করে নামছে। রক্ত জমতে শুরু করেছে নানা জায়গায়। আমার ক্যানসার শুনে মা চিনুরাণী বর্মণ প্রথমে খুব ভেঙে পড়েছিলেন। বাবা অনেক আগে থেকেই আলাদা থাকেন। মা লোকের বাড়ি রান্না করে আমাকে পড়াচ্ছিলেন। পাওয়ারলুমে কাজ নিয়েছিলেন পরে। ক্যানসার শুনে তিনি দিশাহারা। অনেকে কাঠখড় পুড়িয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলাম। পরের প্রায় এক বছর আমার ঠিকানা ছিল মেডিক্যালের বিভিন্ন ওয়ার্ড। অঙ্কোলজি, আই বা মেডিসিন।
ক্যানসারের সঙ্গে লড়াইয়ের প্রথম বছরে আমাকে প্রায় ৭০ বার কেমোথেরাপি নিতে হয়। সেই সঙ্গে বোন ম্যারো টেস্টের মতো যন্ত্রণাদায়ক পরীক্ষা। এর মধ্যে দৃষ্টিশক্তি কমতে শুরু করল। প্রায় ন’মাস দু’চোখে দেখতাম না। রক্ত জমাট বেঁধে ডান চোখ নষ্ট হয়ে গেল। অপারেশন করে কৃত্রিম লেন্স বসানো হলেও দৃষ্টিশক্তি ফিরল না। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে যখন বাড়ি ফিরলাম, ভাল করে বসতে পারি না। বাঁ চোখও ঝাপসা।
তবু ঠিক করি, এম এ পার্ট-টু দেব। ফর্ম ফিলআপের দিন পেরিয়ে গেলেও চিকিৎসার কাগজপত্র দেখিয়ে বিশেষ অনুমতি মিলল। হাতে মাস তিনেক সময়। বন্ধুরা যাবতীয় নোট নিজেদের পয়সায় ফোটোকপি করে বাড়িতে দিয়ে গেল। কিন্তু পড়বে কে? আমি তো ভাল করে দেখতেই পাই না। বেশিক্ষণ বসতেও পারি না। মাসতুতো ভাই নোট পড়ে-পড়ে শোনাত।
পরীক্ষার প্রস্তুতির সঙ্গেই সাত দিন অন্তর হাসপাতালে ছুটেছি। এমএ আমার জীবনে এক মাত্র পরীক্ষা যাতে দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেছি। এর পর বেসরকারি কলেজে বিএড। যাওয়া-আসা মিলিয়ে কুড়ি কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে দু’বছর ক্লাস করেছি। সাইকেল চালালেই কোমরের হাড়ে প্রবল যন্ত্রণা হয়। ওখানে ফুটো করেই তো বোন ম্যারো টেস্ট হত!
মা এখন বেশ কমজোরি। আমি রোজ চার বাড়ি টিউশনি করি। চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিচ্ছি। পাব কি না জানি না। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং অনেক-অনেক মানুষ আমার চিকিৎসা-ওষুধের ব্যবস্থা করেছেন। পাশে পেয়েছি বন্ধুদের শিক্ষকদের। রাতের পর রাত জেগেছে মা।
ওঁরাই তো আমার দেশ!
অনুলিখন: দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy