Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

সুগন্ধী ধান চাষে উত্‌সাহ বাড়ছে নদিয়ায়

সরকারি উদ্যোগে বিদেশে রফতানির সুযোগ তৈরি হওয়ায় সুগন্ধী ধান চাষে উত্‌সাহ বাড়ছে রাজ্যে। দিন দিন এই ধানের চাষ লাভজনক হয়ে উঠছে। মিনিকিটের তুলনায় এই সব সুগন্ধী ধানের ফলন অপেক্ষাকৃত কম হলেও বাজারে দাম মিলছে প্রায় দ্বিগুণ। সেই সঙ্গে লাফিয়ে বাড়ছে চাহিদা। সব দিক বিচার করে নদিয়া জেলার কৃষি দফতর থেকে শুরু করে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ও এখন জেলার চাষীদের ওই সুগন্ধী ধানের চাষে উত্‌সাহিত করছে।

সুস্মিত হালদার
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:০৮
Share: Save:

সরকারি উদ্যোগে বিদেশে রফতানির সুযোগ তৈরি হওয়ায় সুগন্ধী ধান চাষে উত্‌সাহ বাড়ছে রাজ্যে। দিন দিন এই ধানের চাষ লাভজনক হয়ে উঠছে। মিনিকিটের তুলনায় এই সব সুগন্ধী ধানের ফলন অপেক্ষাকৃত কম হলেও বাজারে দাম মিলছে প্রায় দ্বিগুণ। সেই সঙ্গে লাফিয়ে বাড়ছে চাহিদা। সব দিক বিচার করে নদিয়া জেলার কৃষি দফতর থেকে শুরু করে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ও এখন জেলার চাষীদের ওই সুগন্ধী ধানের চাষে উত্‌সাহিত করছে।

বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সত্তরের শেষভাগ থেকে আরব দুনিয়ার দেশগুলিতে সুগন্ধী বাসমতী চাল রফতানি হয়ে আসছে। কিন্তু বাসমতী ছাড়া অন্য কোনও সুগন্ধী চাল বিদেশে রফতানি করর সুযোগ ছিল না। ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে কেন্দ্র সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রকের স্ট্যান্ডিং কমিটি একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল কৃষিজাত পণ্য রফতানির বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য। সেই সময় বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সুগন্ধী ধান হিসাবে গোবিন্দভোগ ও তুলাইপঞ্জিকে রফতানির প্রস্তাব পাঠায়। সঙ্গে প্রয়োজনীয় তথ্য ও ছবি পাঠানো হয়। স্ট্যান্ডিং কমিটি ওই প্রস্তাব বেছে নেয়। ২০১১ সালের মে মাসে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের প্রতিনিধি গিয়ে স্ট্যান্ডিং কমিটির সামনে ‘মৌখিক উপস্থাপনা’ করেন। তাতে স্ট্যান্ডিং কমিটি খুশি হয়ে ওই দুই চাল সম্পর্কে আরও ছবি ও তথ্য চেয়ে পাঠায়। বিশ্ববিদ্যালয় কয়েক দিনের মধ্যে আবারও প্রয়োজনীয় ছবি ও তথ্য পাঠায়। ওই বছরই ২৫ জুলাই স্ট্যান্ডিং কমিটি ‘এক্সপোর্ট অফ ফুড গ্রেস: প্রিমিয়াম নন বাসমতী রাইস অ্যান্ড হুইট’ নামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানে বাসমতী ছাড়াও পাঁচটি জাতের চালকে তালিকাভুক্ত করা হয়। দক্ষিণ ভারতের সোনা, মাট্টি ও পন্নি ছাড়াও গোবিন্দভোগ ও তুলাইপঞ্জি সেই তালিকায় ঢোকে।

বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শস্য বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ বলেন, ‘‘এই রিপোর্ট রাজ্যসভা ও লোকসভায় গৃহীত হয়ে গিয়েছে। বাকি প্রক্রিয়া চলছে এখন। এই প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে কৃষি দফতর থেকেও এই দুই ধান চাষের জন্য কৃষকদের উত্‌সাহিত করা হচ্ছে।’’ একবার বিদেশে রফতানি হলে চাহিদা বেড়ে যাবে। বিশেষ করে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ব্রাজিল, নেপাল ও বাংলাদেশ-সহ একাধিক দেশে এই দুই চালের ব্যপক চাহিদা আছে বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের। বাসমতী ধান উত্তরাখণ্ড, হরিয়ানা, পঞ্জাব, জম্মু-কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশের কিছু অংশে চাষ হয়। কিন্তু গোবিন্দভোগ ও তুলাইপঞ্জি ধান কেবল মাত্র পশ্চিমবঙ্গেই চাষ হয় বলে জানিয়েছেন মৃত্যুঞ্জয়বাবু। ফলে আগামী দিনে এই দুই ধান চাষ করে কৃষকরা আরও বেশি বেশি লাভ করবেন বলেই সকলের ধারণা।

আমাদের রাজ্যে বিভিন্ন রকমের সুগন্ধী ধানের জাত আছে। তার মধ্যে উত্তরবঙ্গের জন্য তুলাইপাঞ্জি, কালোনুনিয়া, তুলসীভোগ, পশ্চিমাঞ্চলের লাল ও কাঁকুড়ে মাটির জন্য রাঁধুনীপাগল, বাদশাভোগ, গোবিন্দভোগ, দানাগুড়ি আর গাঙ্গেয় সমতল ভূমির জন্য গোবিন্দভোগ, বাদশাভোগ, গোপালভোগ, সীতাভোগ এবং উপকূলবর্ত্তী এলাকার জন্য গোবিন্দভোগ, দাদশাল, কনকচূড়, জামাইনাড়ু-সহ একাদিক চালের চাষ হয়।

নদিয়ায় গোবিন্দভোগ, রাধাতিলক, বাদশাভোগ ও বাসমতী ধানের চাষ হয়। গোবিন্দভোগের চাষই হয় সিংহভাগ। কৃষি দফতরের আধিকারিকরা জনিয়েছেন, এই ধানের গন্ধ বৃদ্ধি পায় জৈব সারে। তবে গন্ধ বা গুণগত মান বাড়াতে পরিমাণ মতো সালফার প্রয়োগ করাটা প্রয়োজন। দক্ষিণবঙ্গে জুলাই মাসে ও উত্তরবঙ্গে অগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ধান রোওয়ার কাজ শেষ করে ফেলতে হয়। ফুল আসা বা দানা পুষ্ট হওয়ার সময় ঠান্ডা আবহাওয়া জরুরি। আর চাল তৈরি করার পরে কয়েক মাস সংরক্ষণ করলে ভাতের গুণমান বাড়ে।

জেলার কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, সাধারণ ধানের তুলনায় সুগন্ধী ধান চাষে একর প্রতি প্রায় তিন হাজার থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকা বেশি লাভ হচ্ছে। পুরোদমে বিদেশে রফতানি হতে শুরু করলে সেই লাভের পরিমাণ আরও অনেক বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। গত বছর কৃষি দফতরের উদ্যোগে নদিয়া জেলায় প্রায় ৪০ বিঘা জমিতে সুগন্ধী ধানের চাষ হয়েছে। এই বছর সেটা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১২৫ বিঘা। চাপড়া, হাঁসখালি, করিমপুর-১, চাকদহ ও শান্তিপুর ব্লকে এই সুগন্ধী ধানের চাষ ক্রমশ জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে।

বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ৭৯ জনকে সুগন্ধী ধানের বীজ দেওয়া হয়েছিল। চাষ হয়েছিল ১৩৪ বিঘা জমিতে। ২০১০ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪৮ বিঘা ও ২০১৩ সালে ৮৬৬ বিঘায়। চলতি বছরে আরও দু’শো জনকে নতুন করে ধানের বীজ দেওয়া হয়েছে বলে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি। হরিণঘাটা, চাকদহ, রানাঘাট-১ ও ২, কৃষ্ণনগর-১ ও হাঁসখালি ব্লকে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে চাষ শুরু হয়েছে।

বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে চাষ করছেন হাঁসখালির একটি ফার্মাস ক্লাবের সদস্যরা। তাঁরা এবার প্রায় ৫০ বিঘা জমিতে চাষ করেছেন। এই ক্লাবের অন্যতম কর্মকর্তা নিমাই মণ্ডল বলেন, ‘‘আে গ আমাদের সদস্যদের মধ্যে সুগন্ধী ধান চাষের বিষয়ে একটা জড়তা ছিল। সেটা কাটছে ক্রমশ। এই ধানের চাষে সার, বীজ বা জলের খরচ যে অনেকটাই কম, তা চাষিরা বুঝছেন। পোকার সমস্যাও এই চাষে কম।’’

কৃষি দফতরের সাহায্যে এই ধান চাষ করছেন চাপড়ার পদ্মমালা এলাকার কৃষি সমবায়। সমবায়ের সম্পাদক মানস রায় বলেন, ‘‘আমরা গত বার ৩০ বিঘা জমিতে চাষ করেছিলাম। এবার আমরা ৪৫ বিঘা জমিতে চাষ করেছি। যেখানে মিনিকিট ধান প্রতি বিঘায় ১৮ থেকে ২০ মন উত্‌পাদন হয়, সেখানে সুগন্ধী ধান চাষ করলে মেলে ১১ থকে ১২ মন। কিন্তু ৬০ কেজি মিনিকিটের দাম যেখানে এক হাজার টাকা সেখানে সুগন্ধী ধানের দাম প্রায় দু’হাজার। এছাড়াও অন্য ধানের চেয়ে এই সুগন্ধী ধানের খড় বা বিচুলিও অনেকটা বেশি লম্বা হওয়ায় দাম বেশি মেলে।”

তবে সমস্যাও আছে। সেটা হল ছোট দানার সুগন্ধী ধান ভাঙানোর সমস্যা। লোহার রোলার যুক্ত মেশিনে এই ধান ভাঙালে চাল ভেঙে যায়। সেই কারণে রাবার রোলার যুক্ত মেশিনে এই ধান ভাঙানো উচিত। বিধাননগর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাড়া রাবার রোলার যুক্ত মেশিন এই মুহূর্তে কোথাও নেই। আর সেখানে কেবল মাত্র যাঁরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে চাষ করছেন, তাঁদেরকেই ধান ভাঙানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়। বাকিরা লোহার রোলার যুক্ত মেশিনেই এই ধান ভাঙাতে বাধ্য হচ্ছেন। তাতে চাল ভেঙে যাওয়ায় লাভ কম। সেই কারণে অনেক কৃষকই চাল না করে ধানই বিক্রি করে দিচ্ছেন।

নতুন চাহিদার সঙ্গে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সাহায্যও চলে আসবে ঠিক। চাষিদের মানসিকতার বদলটাতেই তাই আপাতত জোর দিচ্ছেন কৃষিবিজ্ঞানীরা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE