Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়

সহজিয়া সুরে উদ্‌যাপন স্কুলের দেড়শো বছর

বাংলা লোকগানের দল ‘সহজিয়া’ তখন মঞ্চে একমনে গেয়ে চলেছে ‘তু লালপাহাড়ির দ্যাসে যা/ রাঙামাটির দ্যাসে যা...।’ লালবাগ বান্ধব সমিতি ময়দানে অস্থায়ী মঞ্চের নীচে চেয়ার পাতা দু’সারির মাঝে মনের আনন্দে হয়ে নেচে চলেছে স্কুলের ছাত্রীরা। “চুঁচুড়া স্টেশনে বসে একটি একাকী মহুয়া গাছকে দেখে কবি অরুণ চক্রবর্তীর মনে হয়েছিল, ‘তু ইত্থাক্ ক্যানে’? প্রায় ৪২ বছর আগে বসন্তের পড়ন্ত বিকেলে ফুলে-ফুলে রক্তাক্ত মহুয়া গাছকে মনে করে তাঁর লেখা কবিতা, তু লালপাহাড়ির দ্যাসে যা... ” মনে পড়িয়ে দেন সহজিয়া-র দেব চৌধুরী।

রবিবার মঞ্চে ‘সহজিয়া’র সঙ্গীত পরিবেশন । ছবি: গৌতম প্রামাণিক

রবিবার মঞ্চে ‘সহজিয়া’র সঙ্গীত পরিবেশন । ছবি: গৌতম প্রামাণিক

শুভাশিস সৈয়দ
লালবাগ শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:২৬
Share: Save:

বাংলা লোকগানের দল ‘সহজিয়া’ তখন মঞ্চে একমনে গেয়ে চলেছে ‘তু লালপাহাড়ির দ্যাসে যা/ রাঙামাটির দ্যাসে যা...।’

লালবাগ বান্ধব সমিতি ময়দানে অস্থায়ী মঞ্চের নীচে চেয়ার পাতা দু’সারির মাঝে মনের আনন্দে হয়ে নেচে চলেছে স্কুলের ছাত্রীরা। “চুঁচুড়া স্টেশনে বসে একটি একাকী মহুয়া গাছকে দেখে কবি অরুণ চক্রবর্তীর মনে হয়েছিল, ‘তু ইত্থাক্ ক্যানে’? প্রায় ৪২ বছর আগে বসন্তের পড়ন্ত বিকেলে ফুলে-ফুলে রক্তাক্ত মহুয়া গাছকে মনে করে তাঁর লেখা কবিতা, তু লালপাহাড়ির দ্যাসে যা... ” মনে পড়িয়ে দেন সহজিয়া-র দেব চৌধুরী। ওপার বাংলার ভোরাই দিয়ে শুরু করে ভানু সিংহ, লালন, শচীনকত্তাকে ছুঁয়ে ফেলেছে তত ক্ষণে সহজিয়া। বিহু গানের তালে সদ্য নাচ শেষ করে ফের ‘কলরব’।

উপলক্ষ, লালবাগ মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সার্ধ-শতবর্ষ উদ্‌যাপন। গত ৮-১৪ ডিসেম্বর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল। শুরুর চার দিন স্কুলের ছাত্রীদের অনুষ্ঠান। শেষ তিন দিন বরাদ্দ বহিরাগত শিল্পীদের জন্য। রবিবার ছিল সমাপ্তি। সহজিয়ার আগেই আধুনিক গান পরিবেশন করে নেমে গিয়েছেন শম্পা কুণ্ডু। সহজিয়া যেখান থেকে শেষ করেছিল, সেখান থেকেই ধরলেন মনোময় ভট্টাচার্য। আর হাজির ছিলেন ‘মনের মানুষ’ ছবিতে গান গাওয়ার সূত্রে পরিচিতি পাওয়া বাবু ফকির আর তাঁর সুফি ব্যান্ড।

ইতিহাস বলছে, ১৭০৪ সালে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুখসুদাবাদে সরিয়ে নিয়ে আসেন এবং শহরের নাম পাল্টে নিজের নামানুসারে করেন মুর্শিদাবাদ। স্থানীয় ইতিহাসবিদ খাজিম আহমেদ বলেন, “ঔরঙ্গজেবের পৌত্র আজিম-উস-সানের সঙ্গে মতবিরোধের ফলেই মুর্শিদকুলি খাঁ ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে আসেন। এতে ঔরঙ্গজেবের সমর্থন ছিল। পরে ১৭১৭ থেকে ১৭২৭ সাল পর্যন্ত প্রায় স্বাধীন ভাবে সুবে বাংলাকে শাসন করেন তিনি।”

মুর্শিদাবাদ পত্তনের একশো ষাট বছর পরে প্রতিষ্ঠিত হয় স্কুলটি। স্কুলের ঢোকার মুখেই সিমেন্ট খুদে জানানো আছে এই তথ্য। তবে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সম্বন্ধে বিস্তারিত কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এক সময়ে কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী ও তাঁর পরিবারের আর্থিক সহায়তায় স্কুলটি চলত। স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৩১ সালে তত্‌কালীন মুর্শিদাবাদ পুরসভা কর্তৃপক্ষ বছরে পাঁচ টাকা খাজনার বিনিময়ে স্কুলের জমি ৪৯ বছরের জন্য লিজ দিয়েছিলেন বলে পুরনো দলিল-দস্তাবেজে উল্লেখ আছে। সেই জমির উপরে দু’টি দালানযুক্ত ‘বালিকা স্কুল’ ছিল বলেও নথিতে রয়েছে। যদিও স্কুল প্রতিষ্ঠার সময়ে মণীন্দ্রচন্দ্রের বয়স ছিল মাত্র দু’বছর।

পুরনো নথি বলছে, সাতটি পাকা ও দশটি চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি ক্লাসঘর নিয়ে শুরু হয়েছিল পথ চলা। সাধারণ মানুষের অনুদান ও ছাত্রীদের দেওয়া সামান্য ভর্তির ফি থেকেই খরচ চালানো হত। সেই অবস্থায় মুর্শিদাবাদ পুরসভার ধার্য কর কমিয়ে দেওয়ার জন্য আবেদনও জানানো হয়। ১৯৫১ সালের ২ মে পরিচালন সমিতির প্রথম বৈঠক হয়। সেখানে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত আয়-ব্যয়ের হিসেব করার পরে স্কুলের টিনের ছাউনি সংস্কারের কাজে হাত দেওয়া হয়। অর্থাভাব কাটাতে পরিচালন সমিতি শুরু থেকেই নানা রকম চেষ্টা টাসিয়ে এসেছে। তার মধ্যে অন্যতম স্থানীয় ছায়াবাণী সিনেমা হলে বিভিন্ন ‘চ্যারিটি শো’ আয়োজন। তবে টানাটানির মধ্যেও গরিব ছাত্রীদের ভর্তির ক্ষেত্রে ‘ফুল ফ্রি’ ও ‘হাফ ফ্রি’ দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। মেধার ভিত্তিতে ছাত্রীদের পুরস্কারও দেওয়া হত। মহারাজা ও তাঁর পরিবার ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। লালবাগের মদন মণ্ডল এবং নাদের আলি যথাক্রমে ১২৫ টাকা ও ২০০ টাকা দান করেন। স্কুল পরিচালন সমিতির এক সদস্যও ৫০ টাকা অনুদান দেন। সেই রীতি এখনও চলছে। যেমন সার্ধ-শতবর্ষ উদ্‌যাপন সফল করতে বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মীদের পাশাপাশি প্রাক্তনীরাও অর্থ সাহায্য করেছেন। সহকারী প্রধান শিক্ষিকা সোমালী চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এই উত্‌সবের জন্য প্রায় আট লক্ষ টাকার বাজেট করা হয়েছিল। তার মধ্যে দু’লক্ষ টাকা বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মী এবং প্রাক্তনীরা দিয়েছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, এলাকার বিশিষ্ট মানুষজন থেকে শুরু করে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে চাঁদা হিসেবে বাকি টাকা তোলা হয়েছে।” স্কুলের ২২০০ পড়ুয়াও সাধ্যমতো সাহায্য করেছে।

এই উত্‌সবের সৌজন্যে গত কয়েক দিন মনকাড়া কিছু অনুষ্ঠানের সাক্ষী রইল লালবাগ। গত ১২ ডিসেম্বর উদ্বোধনে অনুষ্ঠানে ছিলেন সাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদার। রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়েছেন পূবালি দাম। শোনা গিয়েছে আবৃত্তি আর বাউল। দেখা গিয়েছে রায়বেঁশে, ঋত্বিকের নাটক, পুরুলিয়ার ছৌ। হাজির হয়েছেন ঢোলবাদক ক্ষুদিরাম দাস ও খোলবাদক তিলক মহারাজ। বাপ্পা আর কুশলের গানও মন ছুঁয়েছে। তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে ছাত্রীদের অভিনীত ইংরেজি নাটক, প্রাক্তনীদের শ্রুতিনাটক, শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীদের অনুষ্ঠান।

মনোময় যখন গান শেষ করলেন, ঘড়ির কাঁটা প্রায় মধ্যরাত ছুঁই ছুঁই। নবাবের হাতিশাল-ঘোড়াশালের লাগোয়া ময়দানে ঘাসের ডগায় হিম। শ্রোতারা ঘরের পথ ধরলেন একটু মনখারাপ আর এক বুক উষ্ণতা নিয়ে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE