Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

বিয়ের পিঁড়িতে চোদ্দো শর্ত, শ্রীঘরে বর

পুঁ-পুঁ করে শাঁখ বেজেছে। উলু দিয়েছে এয়োরা। বিয়ের পিঁড়ি পাতা হয়ে গিয়েছে। শুরু হয়েছে মন্ত্র পড়া। চাঁচের বেড়ার ফাঁকে উঁকি দিয়ে সোনালি পাঞ্জাবিতে ঝলমলে বরকে দু’চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে ক্লাস নাইনে পড়া কনে। আর কিছুক্ষণ... চার হাত এক হল বলে! ঠিক তখনই কনের বাবার দিকে কোর্টের কাগজ এগিয়ে দিয়েছেন বর-বাবাজি।

সুস্মিত হালদার
হাঁসখালি শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৫ ০২:৫৩
Share: Save:

পুঁ-পুঁ করে শাঁখ বেজেছে। উলু দিয়েছে এয়োরা। বিয়ের পিঁড়ি পাতা হয়ে গিয়েছে। শুরু হয়েছে মন্ত্র পড়া।

চাঁচের বেড়ার ফাঁকে উঁকি দিয়ে সোনালি পাঞ্জাবিতে ঝলমলে বরকে দু’চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে ক্লাস নাইনে পড়া কনে। আর কিছুক্ষণ... চার হাত এক হল বলে!

ঠিক তখনই কনের বাবার দিকে কোর্টের কাগজ এগিয়ে দিয়েছেন বর-বাবাজি। “এটা কী বাপু?” —বাবা অবাক! “নোটারি করা চুক্তিপত্র”— সটান জবাব বরের। তাতে চোখ বুলিয়ে কনের বাবার চুল খাড়া। এক-দুই করে চোদ্দোটা শর্ত।

বরের দাবি, বিয়ে শুরু হওয়ার আগেই কনের তরফে চুক্তিপত্রে সই করে দিতে হবে। কেমন চুক্তি? একটি এ রকম কোনও ঝামেলা বা অশান্তি হলে কোনও পক্ষ থানায় অথবা আদালতে মামলা বা অভিযোগ দায়ের করতে পারবে না।

এ আবার মানা যায় না কি? শুক্রবার রাতে নদিয়ার হাঁসখালি থানার গাজনা মধ্যপাড়ায় হইচই শুরু হয়ে যায়। রাত ৮টা নাগাদ কৃষ্ণগঞ্জের সত্যনগর থেকে জনা চল্লিশ বরযাত্রী নিয়ে এসে পৌঁছন খানদানি নাপিত, বছর পঁচিশের সনাতন শর্মা। তখনকার খুশি ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে উধাও। যতই কনের বাড়ির লোক, পাড়ার ছেলেরা বোঝান, এমন চুক্তি করা যায় না, বর কিছু কানে তুলতে নারাজ।

এ দিকে বিয়ের লগ্ন পেরিয়ে যায়-যায়। দেখেশুনে খেপে ওঠে বছর ষোলোর কনে। চাঁচের বেড়ার আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে সোজা জানায়, “লগ্নভ্রষ্ট হতে হলে হব। কিন্তু যে বিয়ের আগে যে শর্ত দেয়, তার ঘর করবই না। তাতে আমার জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে।”

বরকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ছবি : সুদীপ ভট্টাচার্য।

আর কেউ সময় নষ্ট করেনি। বরকে তুলে দু’চার ঘা দিয়ে পাশের ঘরে তালাবন্দি করা হয়। বেগতিক বুঝে বরযাত্রীরা সরে পড়েন। মেয়ে বউ নিয়ে থেকে গিয়েছিলেন নিমাই পাল নামে বরের এক বন্ধু ও খুড়তুতো দিদি-জামাইবাবু। তাঁদেরও আটকে রাখা হয়। সনাতনের দিদি স্বপ্না প্রামানিক বলেন, “ভাই যা করেছে, আমার মেয়ের ক্ষেত্রে হলে আমিও বিয়ে দিতাম না। ওর সঙ্গে সম্পর্ক রাখব না।”

তাতে চিঁড়ে ভেজেনি। বরং বিয়ের আয়োজনে যে খরচ হয়েছে, ক্ষতিপূরণ বাবদ তা দিতে হবে বলে দাবি করেন গ্রামবাসী। কেননা গ্রামেরই শ’চারেক লোকের নিমন্ত্রণ ছিল। তা ছাড়া বরপক্ষ কিছু নগদও নিয়েছিল বলে কনেপক্ষের অভিযোগ। কিন্তু শনিবার দুপুর পর্যন্ত আটকে রাখা হলেও সনাতন ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হননি।

শনিবার দুপুরে হাঁসখালি থানার পুলিশ বরকে উদ্ধার করতে গেলে গ্রামবাসী তেড়ে আসে। ঘরের তালা খুলিয়ে সনাতনকে পুলিশের গাড়ির দিকে ছুটিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়েও ভিড় থেকে কিল-চড় ছুটে আসতে থাকে। পুলিশের গাড়ি আটকে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। শেষে গাজনা পঞ্চায়েতের প্রধান চঞ্চল বিশ্বাস এসে পরিস্থিতি সামাল দেন।

কনের বড়দা বলেন, “আমরা ছয় ভাইবোন। এই বোনই সকলের ছোট। খুব কষ্টে বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলাম। সব জলে গেল। কিন্তু পাত্রের শর্তে রাজি হলে তো পরে বোনকে মেরে ফেললেও কিছু করতে পারতাম না!” এমন শর্ত দেওয়াই বা কেন? সনাতনের দাবি, “মেয়ের বয়স ১৬ বছর জেনে আমি বিয়ে করতে চাই নি। ওরা জোর করছিল। তা ছাড়া, বধূ নির্যাতনের মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ঘটনাও তো কম ঘটে না! এই সব ভেবেই কৃষ্ণনগর আদালতে গিয়ে এই চুক্তিপত্র করে এনেছিলাম।”

কনেপক্ষ বিয়ের জন্য জোরাজুরির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। বরং তারা বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস ও টাকা হাতানোর অভিযোগ করায় পুলিশ রাতে সনাতনকে গ্রেফতার করেছে।

আইনি রক্ষাকবচ নিতে চেয়েছিল বর, তাই শেষে হাতকড়া হয়ে গেল!

অঙ্কন: সুমিত্র বসাক।

অন্য বিষয়গুলি:

fourteen demands marriage jail susmit haldar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE