Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

কলকাতাতেও জাল মুসার, তদন্তে হদিস

জঙ্গি এবং ভিন্-দেশি গোয়েন্দা সংস্থার যোগ মিলেছিল আগেই। এ বার জঙ্গি-জাল বিছনোর লক্ষ্যে লাভপুরের মহম্মদ মুসাউদ্দিন ওরফে মুসার কাজ-কারবারে শহর কলকাতার যোগ খুঁজে পেলেন গোয়েন্দারা।

মহম্মদ মুসাউদ্দিন

মহম্মদ মুসাউদ্দিন

শুভাশিস ঘটক ও শিবাজী দে সরকার
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৬ ০৩:৪৯
Share: Save:

জঙ্গি এবং ভিন্-দেশি গোয়েন্দা সংস্থার যোগ মিলেছিল আগেই। এ বার জঙ্গি-জাল বিছনোর লক্ষ্যে লাভপুরের মহম্মদ মুসাউদ্দিন ওরফে মুসার কাজ-কারবারে শহর কলকাতার যোগ খুঁজে পেলেন গোয়েন্দারা।

গোয়েন্দাদের অনুমান, সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়ার সুবাদে কলকাতা চেনা মুসা মূলত দু’ধরনের জাল বিছিয়েছিল। তার মধ্যে একটি তথ্য জোগাড় করার জাল। দ্বিতীয়টি টাকা তোলার। এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, ‘‘আইএস জঙ্গি এবং পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখার জন্য এই দু’টো জালই দরকার। দু’টোই মুসার ছিল বলে জেরায়
জানা গিয়েছে।’’

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে ওই দুই জালের রকম এবং বিস্তৃতি। এক তদন্তকারী দাবি করেছেন, বছর খানেক আগে পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে তথ্য পাচার করার অভিযোগে বন্দর এলাকায় প্রতিরক্ষা দফতরের অধীন গার্ডেনরিচ শিপ বিল্ডার্সের দুই কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ওই দু’জনের সঙ্গে মুসার যোগসূত্র তাঁরা পেয়েছেন।

কেমন সে যোগসূত্র?

গোয়েন্দারা দাবি করেছেন, ধৃতদের সঙ্গে নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ রাখার কথা জেরায় স্বীকার করেছে মুসা। মুসা এ-ও জানিয়েছে, ওয়াটগঞ্জ, মেটিয়াবুরুজ, একবালপুর, হেস্টিংস থানায় এলাকায় ছিল তার ‘কন্ট্যাক্ট’রা। বেশির ভাগই যুবক। তাদের কেউ শিপ বিল্ডার্সে-এর কর্মীর পরিবারের সদস্য, কারও নানা রকম খুচরো কাজের সুবাদে যাতায়াত রয়েছে ফোর্ট উইলিয়ামে। গোয়েন্দারা মনে করছেন, ‘মগজধোলাই’ করে সেই যুবকদের কাছ থেকে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত তথ্য জোগাড় করাটাই ছিল মুসার লক্ষ্য। কারণ, জঙ্গি বা ভিন্-দেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে এ ধরনের তথ্যের দাম অনেক।

মুসার কাছে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত কী ধরনের তথ্য রয়েছে, তা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয় গোয়েন্দাদের কাছে। কারণ, মুসা মোবাইলে বিশেষ ভাবে সুরক্ষিত ‘অ্যাপ’ দিয়ে তথ্য দেওয়া-নেওয়া করত। তার তামিলনাড়ুর ত্রিপ্পুরের ঠিকানায় উদ্ধার হওয়া ল্যাপটপেও কিছু ‘এনক্রিপ্টেড’ (বিশেষ ভাবে সুরক্ষিত) ফাইল পাওয়া গিয়েছে। সেই সূত্র ধরে এক গোয়েন্দা কর্তা বলছেন, ‘‘কোনও জঙ্গি সংগঠন যদি কলকাতায় ঘাঁটি গাড়তে চায়, তা হলে এমন লোককে বাছবে, যার নিজস্ব যোগাযোগের পরিধি বিস্তৃত। সেই নেটওয়ার্ক রীতিমতো সুরক্ষিত। কলকাতার ছেলে না হলেও মুসা এ শহরে নিজের যোগাযোগ তেমন ভাবেই বাড়িয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।’’

‘এনক্রিপ্টেড’ ফাইলগুলি মুসাকে দিয়ে খোলানোর জন্য তার ল্যাপটপটি কলকাতায় আনানো হচ্ছে। মুসার তামিলনাড়ুর বাড়িতে তল্লাশির সময় একটি তরোয়ালও পাওয়া গিয়েছে। ওই বাড়িতেই লুকনো ছিল ল্যাপটপটি।

গোয়েন্দাদের দাবি, আইএসের নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগের পরে কলকাতায় ওই সংগঠনের হয়ে ঘাঁটি গাড়ার মতলবে টাকা তোলার জালও ছড়াতে শুরু করেছিল মুসা। মধ্য কলকাতা ও বন্দর এলাকার অন্তত জনা তিরিশ-পঁয়তিরিশ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নিয়মিত আর্থিক সাহায্য নেওয়া শুরু করেছিল।

জেরায় মুসা গোয়েন্দাদের জানিয়েছে, গত তিন মাসে অন্তত দু’কোটি টাকা সে এ ভাবে তুলেছে। সে টাকা হাওয়ালা পদ্ধতিতে একাধিক দেশেও পাঠিয়েছে সে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে যাঁরা টাকা দিতে ‘কিন্তু-কিন্তু’ করতেন, তাঁদের বাগে আনতে মুসা নিজের আইএস-যোগের কথা বলত। হুমকি দিত ভারতে আইএসের প্রধান শফি আরমারের নাম করে। সে দাবি করত, আরমার তাকে আইএসের ‘বাংলা’ শাখায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন। বিরোধীদের আইএস জঙ্গিরা কী ভাবে শাস্তি দেয়, তা ইউটিউব খুলে দেখিয়ে ভয় দেখাত ওই ব্যবসায়ীদের। আইএসের ‘লোক’কে চটাতে না চেয়ে টাকা দিতে দিতেন ব্যবসায়ীরা। গোয়েন্দাদের দাবি, যে সব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মুসা এ ভাবে টাকা তুলেছে তাঁদের শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁদেরও ধাপে ধাপে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।

সিআইডি সূত্রের খবর, আরও কয়েকজন যুবক রয়েছে আইএসের বাংলা শাখায়, যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ই হল বীরভূমের বাসিন্দা। প্রত্যেকেই মুসার পরিচিত। তাদের সঙ্গে ফোন এবং নানা ‘সোশ্যাল মিডিয়া’য় যোগাযোগ রাখত সে। বাকিদের পরিচয় জানতে কয়েকজনকে জেরা করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে লাভপুরে মুসার বাড়ি লাগোয়া এলাকারও জনা দু’য়েক রয়েছে।

বৃহস্পতিবার মুসার দুই শাগরেদ— আমিন শেখ ওরফে আব্বাসউদ্দিন এবং সাদ্দাম হোসেন ওরফে কালুকে ১৪ দিন সিআইডি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। আর ‘মুসা’র খোঁজ কী করে মিলল?

এ দিন সে বিষয়টিও কিছুটা খোলসা করেছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের দাবি, গত মার্চে বীরভূমের ইলামবাজারে একটি গোষ্ঠী সংঘর্ষের পরে সংঘর্ষের পিছনে কলকাঠি নাড়া লোকেদের তালিকায় মুসা রয়েছে বলে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-কে সতর্ক করে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতর। সে বার্তা পৌঁছয় সিআইডি-র কাছেও। সেই সূত্রেই মুসা গোয়েন্দাদের নজরে ছিল।

অন্য বিষয়গুলি:

Musa attack kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE