Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

রুখে দাঁড়িয়ে বারাসতকে পথ দেখাল কিশোরী মুন্না

ক্যারাটের ক্লাসে প্রতি দিন এক থেকে দেড় ঘণ্টা অনুশীলন করে বছর সতেরোর মেয়েটি। কিন্তু, রবিবার যেন তার অনুশীলন থামতেই চাইছিল না! একাগ্র ছাত্রীটিকে দেখে কেমন সন্দেহ হয়েছিল ক্যারাটে প্রশিক্ষক ভোলানাথ সাউয়ের। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘কী হয়েছে?’’

প্রশিক্ষক ভোলানাথ সাউয়ের সঙ্গে মুন্না। ছবি: সুদীপ ঘোষ।

প্রশিক্ষক ভোলানাথ সাউয়ের সঙ্গে মুন্না। ছবি: সুদীপ ঘোষ।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ১৫:০৭
Share: Save:

ক্যারাটের ক্লাসে প্রতি দিন এক থেকে দেড় ঘণ্টা অনুশীলন করে বছর সতেরোর মেয়েটি। কিন্তু, রবিবার যেন তার অনুশীলন থামতেই চাইছিল না! একাগ্র ছাত্রীটিকে দেখে কেমন সন্দেহ হয়েছিল ক্যারাটে প্রশিক্ষক ভোলানাথ সাউয়ের। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘কী হয়েছে?’’ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে মুন্না দাস নামে ওই কিশোরী। ছাত্রীর মাথায় স্নেহের হাত রাখেন ভোলানাথবাবু। তখন আর নিজেকে সামলাতে পারেনি মুন্না। কাঁদতে কাঁদতেই জানায়, এ বার থেকে সে আরও অনুশীলন করবে। তাকে আরও শক্তিশালী হতে হবে। কিন্তু কেন? মুন্না এ বার ভোলানাথবাবুকে জানায়, ‘‘দিনে চার-পাঁচ ঘণ্টা অনুশীলন না করলে, আরও শক্তিশালী না হয়ে উঠলে নিজেকে বাঁচাতে পারব না স্যার!’’

কিন্তু, বাঁচানোর প্রশ্ন আসছে কেন?

মুন্না জানায়, ওই দিন বিকেল পাঁচটা নাগাদ দোলতলার মেঠোপাড়ার বাড়ি থেকে বারাসতের রথতলায় ক্যারাটে ক্লাসে আসছিল সে। সেই সময় দু’টি ছেলে সাইকেলে তার পিছু নেয়। রাস্তার ভেতরেই নানা ভাবে তাকে উত্যক্ত করতে থাকে তারা। তার কথায়, ‘‘আমাকে লক্ষ করে বাজে ভাষায় কথা বলছিল। অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির পাশাপাশি কুপ্রস্তাবও দেয় ওরা। আমি জিজ্ঞেস করি, তোমাদের সমস্যাটা কী? কিন্তু, সে কথায় কানই দেয়নি ওরা।’’ মুন্না প্রথমে ওদের সতর্ক করে। বলে, ‘‘বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু মুশকিলে পড়বে!’’ ছেলে দু’টি পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘‘কী করবে?’’ মুন্না সাফ জানিয়ে দেয়, ‘‘মারব।’’ এর পরই একটি ছেলে তাকে ধাক্কা দেয়। পাল্টা ধাক্কা দেয় মুন্নাও। তার কথায়, ‘‘ভেবেছিলাম এটুকুতেই ওরা পিছু হঠবে। কিন্তু, তা হয়নি। ধাক্কা খেয়ে ফের আমাকে মারতে আসে ওরা। আমিও পাল্টা মারি। প্রথমে ওরা বুঝতে পারেনি যে, আমি মারামারিটা জানি। যখন বুঝতে পারে আমার সঙ্গে পারবে না, তখন সাইকেল নিয়ে চম্পট দেয়। আমি তাড়া করেও ধরতে পারিনি।’’

ভোলানাথবাবু জানিয়েছেন, সব কথা তাকে বলে মুন্না যেন কিছুটা শান্ত হয়। সে এখন ব্রাউন বেল্ট। ব্ল্যাক বেল্টের থেকে এক ধাপ পিছিয়ে। ছাত্রীর কথা শুনে তিনি তাকে বোঝান, ‘‘তুমি তো ঠিকই করেছ! প্রতিবাদ করেছ। তাও কেন এত ভেঙে পড়ছ?’’ তখন মুন্না তাঁকে জানায়, পালানোর সময় ওই ছেলে দুটো তাকে আরও ছেলে নিয়ে এসে মারার হুমকি দিয়েছে। মুন্নার প্রশ্ন, ‘‘ওরা যদি আবার আক্রমণ করে?’’

সেই আশঙ্কা থেকে ভোলানাথবাবু অনুশীলনের পর রবিবার রাতে মধ্যমগ্রাম থানায় ছাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে এফআইআর করেন। পুলিশ সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তও শুরু করেছে। তবে, বাড়িতে কিছু জানায়নি মুন্না। তার বাবা তরুণ দাস পেশায় ইলেক্ট্রিশিয়ান। তাঁর দুই মেয়ে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে আগে। ছোট মেয়ে মুন্না অভাবের কারণে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশোনা করে ছেড়ে দেয়। এর পর এলাকারই এক শিক্ষকের কাছে ‘স্পোকেন ইংলিশ’ শিখতে শুরু করে সে। ওই শিক্ষককেই সে প্রথম জানায়, তার ক্যারাটে প্রীতির কথা। মেয়েটির আগ্রহ দেখে তাকে ভোলানাথবাবুর স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন তিনি। বারাসত এলাকায় বেশ কয়েকটি জায়গায় ক্যারাটে শেখান ভোলানাথবাবু। সব মিলিয়ে তাঁর হাজারখানেক ছাত্রছাত্রী। ভোলানাথবাবুর বাড়িতেই শিখতে যেত মুন্না। সেখানেও শ’খানেক ছাত্রছাত্রী তাঁর। এর মধ্যে প্রায় ৪০ জনই মেয়ে। যাদের বয়স তিন থেকে তিরিশ।

ভোলানাথবাবু জানিয়েছেন, বারাসত এলাকায় ইদানীং মেয়েদের মধ্যে ক্যারাটে শেখার আগ্রহ বেড়েছে। এ সেই বারাসত। যেখানে গত কয়েক বছরে একের পর এক শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে। দিদি রিঙ্কু দাসের সম্মান বাঁচাতে গিয়ে খুন হয়েছিলেন ভাই রাজীব দাস। কলেজে পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে ধর্ষণের পর খুন হতে হয় কামদুনির এক ছাত্রীকে। মধ্যমগ্রামেও এক কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়। থানায় সেই অভিযোগ জানিয়ে ফেরার পথে ফের তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়। পরে আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয় ওই কিশোরীর। সেই বারাসতেই আত্মরক্ষার্থে এখন ক্যারাটে শেখার চল বেড়েছে। মুন্না তারই উদাহরণ।

গরিব পরিবারের মেয়ে বলে তার কাছ থেকে কোনও টাকা নিতেন না ভোলানাথবাবু। এমনকী, তাঁর বাড়ির স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের শেখানোর ভার তিনি মুন্নার উপরেই দিয়েছিলেন। এ ছাড়া মুন্না বেশ কয়েকটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ক্যারাটে শেখায়। একটি স্কুলে যোগব্যায়ামও শেখায় সে। ক্যারাটে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পাশাপাশি স্যারের মতো সে ভবিষ্যতে ক্যারাটে শেখানোকেই পেশা হিসেবে বেছে নিতে চায়। তবে, তার বাবা চান না মুন্না ক্যারাটে শিখুক।

সোমবার রাত দেড়টা নাগাদ মধ্যমগ্রাম থানার পুলিশ একটি ছবি নিয়ে তার বাড়িতে যায়। অভিযুক্তদের কারও সঙ্গে ওই ছবির মিল আছে কি না তা জানতে চায় তারা। এই ঘটনায় একটু ক্ষুণ্ণ হয়েছে মুন্না। তার কথায়, ‘‘বাবা জানতে পারলে খুব বকবেন।’’ পুলিশের দাবি, যে হেতু এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় তাই দুষ্কৃতীদের শনাক্তকরণের জন্য ওই কিশোরীর বাড়িতে যাওয়া হয়। বার বার থানায় ডেকে পাঠালে ওকে বিব্রতই করা হবে।

উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘মেয়েটি যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে, তাকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। পুলিশের সঙ্গে যে সহযোগিতা করছে সে তা অতি প্রশংসনীয়। আমরা কয়েক জনকে আটক করেছি। তবে মূল অভিযুক্ত এখনও ধরা পড়েনি। সিআইডি থেকে শিল্পী নিয়ে এসে মেয়েটির বর্ণনা অনুযায়ী দুষ্কৃতীদের ছবি আঁকানো হচ্ছে। আশা করছি খুব শীঘ্রই তারা ধরা পড়বে।’’

এ দিন আনন্দবাজারের কাছে মুন্নার এই ঘটনার কথা শুনে রিঙ্কু দাস বলেন, ‘‘অনেক দিন পর একটা ভাল খবর শুনলাম। ভাই বা আমি যদি ক্যারাটে জানতাম, তবে সে দিন অমনটা না-ও হতে পারত। তিন জনের আক্রমণের মুখে আমরা আরও বড় প্রতিরোধ গড়তে পারতাম। যাই হোক, মুন্নার কথা শুনে সাহস পাচ্ছি নতুন করে। মেয়েকে ক্যারাটে শেখানোর আগ্রহটাও ভেতর থেকে টের পাচ্ছি।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Munna teenage girl Barasat Police Kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE