Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

বুক পকেটে হনুমান চালিশা থেকে গলায় রুদ্রাক্ষ

লম্বায় অন্তত হাতদুয়েক। নেপালের পশুপতিনাথের রুদ্রাক্ষের মালা। দু’ফেরতা দিয়ে পেঁচিয়ে সেই মালা তাঁর গলায় পরম ভক্তিতে জড়িয়ে দিলেন আলিপুরদুয়ারের প্রত্যন্ত প্রান্ত থেকে আসা এক দল নেতা-কর্মী। তাঁদের কাতর আর্জি, “দাদা, এটা প্রসাদী মালা। সেই সকাল থেকে আমাদের কাছে রয়েছে। আর বেশি ক্ষণ আমাদের হাতে রাখা ঠিক হবে না!” মালা পরেই অনুগামী নেতা-কর্মীদের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন দাদা। বললেন, “এই দিনটা না এলে বুঝতে পারতাম না, বাংলার মানুষ আমাকে এত ভালবাসে!”

পকেটে হনুমান চালিশা। সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে আসছেন মুকুল রায়। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

পকেটে হনুমান চালিশা। সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে আসছেন মুকুল রায়। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

সঞ্জয় সিংহ
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:২৭
Share: Save:

লম্বায় অন্তত হাতদুয়েক। নেপালের পশুপতিনাথের রুদ্রাক্ষের মালা। দু’ফেরতা দিয়ে পেঁচিয়ে সেই মালা তাঁর গলায় পরম ভক্তিতে জড়িয়ে দিলেন আলিপুরদুয়ারের প্রত্যন্ত প্রান্ত থেকে আসা এক দল নেতা-কর্মী। তাঁদের কাতর আর্জি, “দাদা, এটা প্রসাদী মালা। সেই সকাল থেকে আমাদের কাছে রয়েছে। আর বেশি ক্ষণ আমাদের হাতে রাখা ঠিক হবে না!” মালা পরেই অনুগামী নেতা-কর্মীদের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন দাদা। বললেন, “এই দিনটা না এলে বুঝতে পারতাম না, বাংলার মানুষ আমাকে এত ভালবাসে!”

প্রথম দিন সিবিআইয়ের প্রশ্নবাণ সামলে নিজের উইকেট বাঁচিয়ে ফিরে মুকুল রায়ের কণ্ঠে বাংলার মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা! তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের জন্য আলাদা করে কিছু নয় কিন্তু! আপাতত ফাঁড়া কেটেছে, তাতেই উদ্বেল তাঁকে ঘিরে-থাকা অনুগামীরা। তাঁদের ভালবাসায় আপ্লুত তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকও। কিন্তু সে সব অনুভূতি তিনি ভাগ করে নিতে চাইলেন আম জনতার সঙ্গে। তৃণমূলের কোনও অনুষঙ্গ রাখলেন না!

চেনা ঠান্ডা মেজাজের মধ্যেও এ যেন এক অন্য মুকুল! সারদা-কাণ্ডে জেরার প্রবল চাপ সামলে যিনি নিজের মতো করে দেখিয়ে দিচ্ছেন, শাসক দলে সংগঠন এখনও তাঁর হাতের মুঠোয়। দেখিয়ে দিচ্ছেন, তৃণমূলকে না জড়িয়েইা! দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের প্রতি সংগঠনের ‘দ্বিতীয় ব্যক্তি’র বার্তা যেন স্পষ্ট! সংগঠনের রাশ যতই ‘যুবরাজ’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা হোক, শুক্রবারের মুকুল বোঝাচ্ছেন দলে গুরুত্ব খর্ব হলেও আম নেতা-কর্মীর কাছে ‘দাদা’ তিনিই!

এমনিতে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে জানেন ভালই। তবু এ দিন বিকেলে সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে আসার পরে সেই মুকুলই ঈষৎ আবেগতাড়িত। পরনের সাদা পাঞ্জাবির বুক পকেটে রাখা হনুমান চালিশা উঁকি দিচ্ছে। সেখানে বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছে তাঁর ডান হাত। দলীয় এক কর্মীর কাছে থেকে চেয়ে নেওয়া সিগারেটে আয়েশের টান দিয়ে মুকুল বলছেন, “অনেক দিন রাজনীতি করছি। কিন্তু আজ আমার একটা দারুণ উপলব্ধি হয়েছে!” গলার স্বর যেন একটু কাঁপছে। একটু থেমে তাঁর সংযোজন, “বাংলার মানুষ যে আমায় এত ভালবাসেন, কেউ দোওয়া মাঙছেন, কেউ প্রসাদী ফুল দিচ্ছেন, কেউ মুখে প্রসাদ গুঁজে দিচ্ছেন। যে ভালবাসা মানুষের কাছ থেকে পেলাম, জীবনে ভুলব না!”

সিবিআই দফতর থেকে বেরিয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠ দলীয় বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের সঙ্গে মুকুল গিয়েছিলেন সিএফ ব্লকে স্থানীয় পুরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের অফিসে। সেখানেই উত্তরবঙ্গের নেতা-কর্মীরা তাঁকে রুদ্রাক্ষের মালা পরিয়ে দেন। গিজ গিজ করছে ভিড়। আলিপুরদুয়ার শুধু নয়, মেদিনীপুর, বালি, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নেতা-কর্মীরা আছেন সেখানে। ওই দফতরের সামনেই সব্যসাচীর ব্যবস্থাপনায় একটা ছোট মঞ্চ হয়েছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে মুকুল ‘কৃতজ্ঞতা’ জানালেন ‘বাংলার মানুষকে’। ভিড়ে ঠাসাঠাসি ঘরে চেয়ারে বসেছেন সবে, সব্যসাচী বললেন, “মুকুলদা, পিছনের জানলার দিকে এক বার তাকাও।” হাসিমুখে মুকুল জানলার দিকে তাকাতেই দেখেন, একটা বছর দশেকের বাচ্চা ছেলে তাঁর দিকে তাকিয়ে। সব্যসাচী বলেন, “ও তোমাকে দেখবে বলে ঘণ্টাদেড়েক এখানে দাঁড়িয়ে!”

সারা দিন বিশেষ কিছু মুখে তোলার ফুরসত পাননি। সল্টলেকের ওই দফতরে একটা সিঙাড়া মুখে পুরে জল খেলেন ঢক ঢক করে। সঙ্গে রসিকতা, “এই যা খেলাম, রাত ১১টা পর্যন্ত নিশ্চিন্ত! আর কিছু খেতে হবে না। অম্বল অবধারিত!” শুনে দলের নেতা হাজি নুরুল, সৌরভ চক্রবর্তী, কাউন্সিলর শান্তনু সেনদের মুখেও হাসি। এর পরে এল চা। ইতিমধ্যে সেই ঘরে হাজির হলদিয়ার বিধায়ক শিউলি সাহা, বীজপুরের বিধায়ক মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশু, ব্যারাকপুরের বিধায়ক শীলভদ্র দত্ত প্রমুখ। সকলেরই চোখ মুখে স্বস্তির ছাপ।

সিবিআইয়ের বাধা আপাতত টপকাতে পেরে মুকুলও যেন আবার সেই বিচক্ষণ সংগঠক! ভিড়ের মধ্যে থেকে কে এক জন বলল, “দাদা, সেই সকাল থেকে আমরা আছি।” মুকুল হেসে বললেন, “জানি। বালির কানু-জহর কোথায়? শোন, ভাল করে বালিটা এ বার ধর!” আবার ভিড়ের মধ্যে থেকে মুখ বাড়িয়ে এক যুবক বললেন, “দাদা, আমরা ভোর না হতেই এখানে চলে এসেছি।” মুকুল সকলের সঙ্গে সেই যুবকের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, “মেদিনীপুরের গোপাল।” এর পর মুকুলের কথা শুরু হল হরিণঘাটা, কল্যাণী, বারুইপুর, সোনারপুর থেকে আসা অনুগামীদের সঙ্গে। ইতিমধ্যে কেউ এক জন জানালেন, সিবিআইয়ের ফাঁড়া কাটায় বীজপুরে দলীয় কর্মীরা ‘রক-মিউজিকে’র আসর আয়োজন করছে। সঙ্গে সঙ্গে মুকুল তাঁর ছেলেকে ডেকে বললেন, “হাপুন, (শুভ্রাংশুর ডাক নাম) দেখ ও সব যেন না হয়!”

বীজপুর শুধু নয়, খবর আসতে শুরু করেছে কাঁচরাপাড়ার তৃণমূল কর্মীরা আবির খেলে, পটকা ফাটিয়ে রীতিমতো উচ্ছ্বাস করছেন। মুকুলের জয়ধ্বনি দিয়ে মিছিল পরিক্রমা করেছে গোটা শহর! মিষ্টি বিতরণ হয়েছে বীজপুরের বহু এলাকায়। দুর্গাপুর-সহ আরও নানা এলাকায় একই ছবি! তবে উচ্ছ্বাস যাতে মাত্রা না ছাড়ায় তার জন্য মুকুল বারবার নির্দেশ দিয়েছেন অনুগামীদের। মন্ত্রী মদন মিত্রকে জেরার সময় বা তাঁকে আদালতে তোলার সময় যে বিক্ষোভ, হইহল্লা হয়েছে, কোনও অবস্থায় তার পুনরাবৃত্তি চাননি মুকুল।

সিবিআই দফতরে তাঁর হাজিরার সময়ে এ দিন ‘অনভিপ্রেত’ কিছু যাতে না ঘটে, তার জন্য তিনি আগাম হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। দলীয় সূত্রে খবর, সিজিও কমপ্লেক্সে দলীয় কর্মীদের অবাঞ্ছিত ভিড় এড়ানোর জন্যেই সব্যসাচী পুরসভার ওয়ার্ড অফিসের সামনে মঞ্চ করেছিলেন। তাঁরা নিশ্চিত করেছিলেন, “মদনের মতো অবস্থা দাদার হবে না!” তাই সিবিআই দফতরের সামনে না যেতে দিয়ে ভিড়টাকে ওই মঞ্চের দিকেই আটকে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন সব্যসাচী। সেই মঞ্চ থেকেই মুকুল ফের দাবি করেছেন, জীবনে তিনি কোনও অন্যায় বা অনৈতিক কাজে ব্যক্তিগত বা দলগত ভাবে যুক্ত ছিলেন না।

মুকুলের প্রথম জেরা-পর্ব মেটার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আজ, শনিবার কালীঘাটে দলের সাংসদ-বিধায়কদের নিয়ে বৈঠক ডেকেছেন তৃণমূল নেত্রী। তিনি কি সেখানে যাবেন? মুকুলের মন্তব্য, “না যাওয়ার তো কোনও কারণ নেই! তবে আগে বাড়ি যাই। বাড়ির লোকেরা তো এত দিন টেনশনে মারা যাচ্ছিল! ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। আমার একটা মানতও আছে। সেটা পালন করব!” জানালেন, সিবিআই দফতরে যাওয়ার আগে ফোনে স্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছিল। সামনেই বনগাঁ লোকসভা এবং কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচন। প্রচারের ব্যাপারে মুকুল বলছেন, “যাব তো নিশ্চয়ই! তবে দু-একটা দিন যাক। তার পরে স্বাভাবিক কাজকর্ম করব!”

সল্টলেক থেকে মুকুল গিয়েছিলেন নিজাম প্যালেসে নিজের দফতরে। সেখানে দেখা করতে এলেন ফিরহাদ (ববি) হাকিমের মতো মন্ত্রীরা। ববিদের সঙ্গে কথা বলার সময়েও মুকুলের ডান হাতে ধাগা বেঁধে যাচ্ছেন অনুগামীরা! উপভোগই করছেন মুকুল। হাসিমুখেই বলে ফেলছেন, “আমি এখন বটগাছ! কত কী যে মানুষ, এই হাতে বাঁধছেন। সবই তো ভালবেসে, তাই না!”

অন্য বিষয়গুলি:

Mukul Roy Sarada Hanuman Chalisa
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE