দলে ‘ফার্স্ট বয়’-এর শিরোপা আগেই গিয়েছিল। এ বার তাঁকে একেবারে ‘লাস্ট বেঞ্চে’ ঠেলে দিয়ে দলগত ভাবে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেল।
রাজ্যসভায় সাংসদ মুকুল রায়ের আসন বদল করতে উদ্যোগী হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে রাজ্যসভার চেয়ারম্যানকে নোটিস পাঠিয়ে বলা হয়েছে, মুকুলের জন্য যেন রাজ্যসভার সপ্তম অর্থাৎ একেবারে শেষ সারির একটি আসন বরাদ্দ করা হয়। আগামীকাল থেকেই যাতে এই নতুন ব্যবস্থা বলবৎ হয়, সেটি নিশ্চিত করতে চাইছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। পাশাপাশি ডেরেক ও ব্রায়েনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, ইদানীং কালে মুকুল দলবিরোধী যে সব কথাবার্তা বলেছেন, তার তালিকা তৈরি করতে। দলের অন্দরে অনেকেই মনে করছেন, শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে মুকুলের বিরুদ্ধে এ বার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দিকেই এগোচ্ছেন নেত্রী।
গত কয়েক সপ্তাহে একে একে সব দলীয় পদই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল মুকুলের। তার পরেও ফের তাঁর আসনে কোপ পড়ল কেন? কেন তাঁর জন্য ধার্য হল কুণাল ঘোষের পাশের আসনটি? আর কেনই বা তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হল?
দলীয় সূত্রের খবর, গত কয়েক দিন মুকুল যে ভাবে লাগাতার দলবিরোধী কথাবার্তা বলছিলেন, তা নিয়ে অসন্তোষ জমছিলই। কিন্তু বারুদের স্তূপে দেশলাই কাঠির কাজ করেছে তৃণমূল ভবনে সিবিআই নোটিস পাঠানোর খবর। তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের ধারণা যে দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলীয় সাংসদদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দিল্লিতে বৈঠক করলেন, সেই দিনই সিবিআই নোটিসের খবরটি রীতিমতো পরিকল্পনা করে সংবাদমাধ্যমে ফাঁস করা হয়েছে। এবং দলনেত্রীর বিশ্বাস, এর পিছনে অন্যতম ভূমিকা মুকুল রায়েরই।
সারদা মামলার তদন্তে সিবিআই তৃণমূল ভবনকে নোটিস পাঠিয়েছিল গত ৫ মার্চ। খবরটি কিন্তু তখন সংবাদমাধ্যমে আসেনি। গত কাল, মোদী-মমতা বৈঠকের দিনই তা সামনে আসে। এটা নিছক কাকতালীয় বলে মানতে পারছে না দল। তৃণমূলের রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও ব্রায়েন এ দিন মুকুল রায়ের নাম না-করেও তাঁর সন্দেহ গোপন করেননি। বলেছেন, “সিবিআই-এর চিঠি ফাঁস করার জন্য যে সময়টি বেছে নেওয়া হয়েছে, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই চিঠির একটি কপি অন্য এক ব্যক্তিকেও পাঠানো হয়েছিল। এমন দিনে এটি ফাঁস হল, যেদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নরেন্দ্র মোদী দিল্লিতে বৈঠক করছেন।” ডেরেকের উল্লিখিত ‘অন্য এক ব্যক্তি’ মুকুল রায় বলেই দলীয় সূত্রের খবর।
ঘটনাচক্রে আজ সকালেই রাজধানীতে এসে পৌঁছেছেন মুকুল। সাউথ অ্যাভিনিউয়ে তাঁর বাড়ি থেকে কয়েকটি বাড়ি পরেই রয়েছেন মমতা। তিনি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলোয় উঠেছেন। আজ সন্ধেয় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করা ছাড়া সারাদিন ঘরেই কাটিয়েছেন। গত কালের ঘটনার পরে তাঁর সঙ্গে মুকুলের দূরত্ব যেন এক লাফে আরও অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। তাই শাস্তিস্বরূপ মুকুলকে শুধু পিছনের বেঞ্চে পাঠানোই নয়। তৃণমূলের শৃঙ্খলারক্ষাকারী কমিটির পক্ষ থেকে রাজ্যসভার নেতা ডেরেককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সাম্প্রতিক অতীতে মুকুল যে সব দলবিরোধী মন্তব্য করেছেন, সেগুলি সংগ্রহ করে দ্রুত একটি তথ্যপঞ্জি তৈরি করতে। ডেরেকের কথায়, “মুকুল রায় এমন সব বিবৃতি দিচ্ছেন যেগুলির সঙ্গে দলের অবস্থানের আদৌ কোনও মিল নেই। আমায় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এই মন্তব্যগুলি একত্র করে একটি তথ্যপঞ্জি বানানোর জন্য।” তথ্যপঞ্জি তৈরির পর মুকুলের বিরুদ্ধে আরও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা, তা অবশ্য স্পষ্ট করেননি তিনি।
অথচ শীতকালীন অধিবেশনেও রাজ্যসভায় প্রথম সারির আসন বরাদ্দ ছিল তখনও দলের ‘নাম্বার টু’ মুকুল রায়ের জন্য। তার পর তাঁকে পাঠানো হল তিন-এ। আজ একেবারে লাস্ট বেঞ্চার! কী ভাবে দেখছেন এই পশ্চাদপসারণ? হাসতে হাসতে মুকুল বললেন, “সংসদের বাইরে তো পাঠায়নি! সংসদ মানুষের জন্য। আমি মানুষের সঙ্গেই রয়েছি।” এর পর যোগ করলেন, “গারফিল্ড সোবার্স খেলা শুরু করেছিলেন সেকেন্ড ডাউন থেকে। পরে ব্যাটিং অর্ডারে নেমে যান সেভেন্থ ডাউন-এ। সঙ্গে চায়নাম্যান এবং গুগলি বোলিংও করতেন। ক্রিকেট যত দিন থাকবে, সোবার্স-এর নামও থাকবে!”
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সোবার্স-এর মতো দাপট নিয়ে মুকুলবাবু বিচরণ করতে পারবেন কিনা, সেটা সময়ই বলবে। দলীয় মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় যেমন সিউড়িতে এ দিন কটাক্ষ করে বলেছেন, “আগে (মুকুল) বিমানে (দিল্লি) যেতেন। এখন রাজধানীতে যাচ্ছেন। এর পরে সাধারণ ট্রেনে যাবেন!’’
আপাতত, মুকুল নিজেও বুঝছেন, লড়াইটা কঠিন। দল যদি সঙ্গে না নেয়, তা হলে আগামী ১৪ই মার্চ স্বতন্ত্র ভাবে নন্দীগ্রাম যাবেন বলে ঠিক করেছেন। কারণ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তাঁর সুর যত চড়া হচ্ছে, তাঁর প্রতি দলের কোপও তত বাড়ছে। রাজ্যসভার নেতা থেকে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের পদ সবই কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এ বার শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে আরও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলেই দলীয় সূত্রের ইঙ্গিত। সেই কারণেই সম্প্রতি মুকুল কী কী দলবিরোধী কথা বলেছেন, তার তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে।
আইআরসিটিসি-র সারদা বরাত নিয়ে বিতর্কের সময় থেকেই কার্যত মুকুলের ভিন্ন স্বরে কথা বলা শুরু। অভিযোগটিকে নস্যাৎ না-করে মুকুল শুধু বলেছিলেন, তাঁর রেলমন্ত্রিত্বের মেয়াদে ঘটনাটি ঘটেনি। তার পরে গত কয়েক সপ্তাহ মুকুল একের পর এক বোমা ফাটিয়েছেন। কখনও কায়দা করে ডেলো বাংলোয় সারদা-কর্তার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। কখনও সংসদে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার সংশোধনী প্রস্তাব আনার বিরোধিতা করেছেন। কখনও দলীয় লাইন না মেনে রেল বাজেট এবং সাধারণ বাজেটের প্রশংসা করেছেন। নাম না-করে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিঁধেছেন। সংখ্যালঘু উন্নয়নে রাজ্য সরকার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি বলে মন্তব্য করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক নিয়ে ফুট কেটে বলেছেন, ঘটনাটা আরও আগে হলেই ভাল হতো।
এর প্রত্যেকটি ঘটনাই দলীয় নেতৃত্বের নজরে ছিল। দলীয় সূত্রের খবর, মুকুলকে এত দিন দলের মধ্যে ক্রমশ একঘরে করে দিচ্ছিলেন নেত্রী। কিন্তু গত কালের পরে আরও কঠোর পদক্ষেপের কথা ভাবা হচ্ছে। মুকুলকে অপদস্থ করতে তাঁকে শোকজ করাও হতে পারে। এমনিতে দলের মধ্যে একাংশের মত হল, মুকুলকে বহিষ্কার করলে ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই। কারণ সেক্ষেত্রে রাজ্যসভার পদটি মুকুলের অটুট থেকে যাবে। অন্য দিকে দলের অনুশাসনের বাইরে চলে গেলে, তৃণমূলকে ভাঙার জন্য অনেকটাই খোলা মাঠ পেয়ে যাবেন এই বিদ্রোহী নেতা। আবার আর একটি অংশ মনে করেন, দলের মধ্যে থেকে প্রতিদিন মুকুল যে ভাবে দলের অস্বস্তি বাড়াচ্ছেন, তার হাত থেকে নিস্তার পাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেটা শেষ পর্যন্ত মমতাই স্থির করবেন। আপাতত রাজ্যসভায় মুকুলের স্থান কুণালের আসনের পাশে। কুণাল ঘোষ, দলের সাসপেন্ডেড সাংসদ। এবং জেলবন্দি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy