Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

হোমের নজরে খামতি, নাবালকরা ফের অপরাধে

বরুণ বিশ্বাস খুনের মামলায় চার বছর আগে অভিযোগ উঠেছিল তার নামে। সুপারি পেয়ে ভরা স্টেশনের বাইরে বরুণকে গুলি করার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয় দশম শ্রেণির পড়ুয়া, সেই কিশোর।

বরুণ বিশ্বাস খুনে অভিযুক্ত সে দিনের নাবালক অপরাধী সুমন্ত এখন তরুণ। — নিজস্ব চিত্র

বরুণ বিশ্বাস খুনে অভিযুক্ত সে দিনের নাবালক অপরাধী সুমন্ত এখন তরুণ। — নিজস্ব চিত্র

দীক্ষা ভুঁইয়া
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৬ ০৯:২৯
Share: Save:

বরুণ বিশ্বাস খুনের মামলায় চার বছর আগে অভিযোগ উঠেছিল তার নামে। সুপারি পেয়ে ভরা স্টেশনের বাইরে বরুণকে গুলি করার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয় দশম শ্রেণির পড়ুয়া, সেই কিশোর।

সে যাত্রা নাবালক বলে অল্পে ছাড়া পেয়ে যায় সে। জুভেনাইল জাস্টিস (জে জে) বোর্ডের নির্দেশে তিন বছর সরকারি হোমে কাটিয়ে বেরনোর পরে সে এখন সদ্য যুবক। এবং বেরিয়েই ফের একটি খুনের ঘটনায় ছেলেটি জড়িয়েছে বলে অভিযোগ। সুমন্ত বিশ্বাস নামে সেই তরুণকে এখন হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ।

এ যাত্রা, ২৮ এপ্রিল হাবড়ার ঘোজের মাঠে কল্যাণী বৈরাগী নামে এক মহিলাকে খুনের অভিযোগ উঠেছে সুমন্তের বিরুদ্ধে। কল্যাণী এবং তাঁর স্বামী ভবেন বৈরাগীর বাড়িতে ঢুকে সুমন্ত এবং আরও কয়েক জন দুষ্কৃতী হামলা চালায় বলে অভিযোগ। কল্যাণীদেবীর গলার নলি কেটে সুমন্ত তাঁকে খুন করে বলেও তদন্তে জানা গিয়েছে। ভবেনবাবু এখন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কলকাতার একটি সরকারি হাসপাতালে চিকিত্সাধীন। তাঁর দাবি, ‘‘কল্যাণী মারা যাওয়ার আগে সুমন্তই ওর গলায় কোপ দিয়েছিল, এটা বার বার বলে গিয়েছে।’’

কয়েক বছরের মধ্যে পর পর দু’টি খুনে জড়িত সুমন্তর ‘কীর্তি’ নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠছে। নাবালকদের অপরাধের শাস্তির মাত্রা ও কার্যকারিতা নিয়ে দেশ জুড়ে বিতর্ক চলছে বেশ কিছু দিন। মাস কয়েক আগে দিল্লিতে নির্ভয়া-কাণ্ডের নাবালক অপরাধীকে তিন বছর হোমে রেখে রেহাই দেওয়ার ঘটনা নিয়েও সমালোচনা হয়েছিল বিস্তর। এই পটভূমিতে হোম থেকে ছাড়া পেয়েই সুমন্তের ‘দুষ্কর্মে’র পুনরাবৃত্তিও নাবালকের অপরাধমনস্কতার নিরাময়ে এ দেশের চলতি সরকারি ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিল।

নির্ভয়া-কাণ্ডের পরে অবশ্য খুন বা ধর্ষণের মতো অপরাধকে ‘ঘৃণ্যতম’ আখ্যা দিয়ে আইন কিছুটা পাল্টানো হয়েছে। নয়া আইন অনুযায়ী, এ সব ক্ষেত্রে অপরাধীর বয়স ১৬ হলেই সে প্রাপ্তবয়স্কদের সমান শাস্তি পাবে। এর আগে পর্যন্ত নাবালক অপরাধীদের তিন বছর হোমে রেখে তাদের মানসিকতা বদলের চেষ্টাই করা হতো। কিন্তু তাতে যে সব সময় ফল মিলছে না, তা এ বার বোঝা যাচ্ছে। সুমন্তের ঘটনা প্রসঙ্গে হাইকোর্টের আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এটা নাবালক অপরাধীর সংশোধনে সরকারি পদ্ধতির ব্যর্থতা বলেই ধরতে হবে।’’ আর মনস্তত্ত্বের শিক্ষক নীলাঞ্জনা সান্যালের বক্তব্য, ‘‘কিশোর অপরাধীকে নিয়মিত কাউন্সেলিং করা না-হলে কিন্তু তার অপরাধপ্রবণতা শুধরোয় না। বরং কিছু দিন বাদে ছাড়া পেয়ে যাবে জেনে সে ধরাকে সরা ভাবতে পারে!’’

নীলাঞ্জনাদেবীর মতে, কোনও অপরাধীকে সরকারি হোম থেকে ছাড়ার আগে তার মনস্তত্ত্ব জরিপ করা বা ‘সাইকোমেট্রিক ইভ্যালুয়েশন’ জরুরি। বিশেষজ্ঞ মনস্তত্ত্ববিদের শংসাপত্র ছাড়া তাকে ছাড়া উচিত নয়। সেই সঙ্গে ছাড়া পাওয়ার পরও অন্তত বছর খানেক ওই অপরাধীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তার ভাবগতিক ভাল ভাবে খেয়াল রাখা আবশ্যক। খাতায়-কলমে এ রাজ্যের সরকারি হোম থেকে ছাড়া পাওয়া নাবালক অপরাধীদের ক্ষেত্রেও এ সব নিয়মের কিছু-কিছু মেনে চলার কথা। সুমন্ত বিশ্বাসের ঘটনা থেকে প্রশ্ন উঠছে, তার ক্ষেত্রে আদৌ এ সব সতর্কতার পরোয়া করা হয়েছিল কি না!

২০১২ সালের জুলাইয়ে সুটিয়ার প্রতিবাদী যুবক বরুণ বিশ্বাসকে খুনের পরে সুমন্তের ঠাঁই হয়েছিল আড়িয়াদহের সরকারি হোম, ধ্রুবাশ্রমে। দোহারা চেহারার ছেলেটি আপাত ভাবে সবার সঙ্গেই ভাল ব্যবহার করত। হোমে থেকে সে উচ্চ মাধ্যমিক পাশও করে। কিন্তু হোমে সুমন্ত বা তার মতো অন্য নাবালকদের ঠিকঠাক ‘কাউন্সেলিং’ বা নজরদারিতে খামতি ছিল বলে এখন অভিযোগ উঠছে। পুলিশি তদন্তে জানা গিয়েছে, ধ্রুবাশ্রমে থাকাকালীনই সুমন্তের সঙ্গে বরুণ বিশ্বাস খুনের অন্য অভিযুক্তদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।

পুলিশ সূত্রের খবর, হোম থেকে বেরোনোর পরে সুমন্ত যে মহিলাকে খুন করেছে বলে অভিযোগ, তিনি ওর ধ্রুবাশ্রমের সতীর্থ দুই ভাইয়েরই মা। নৃপেন মণ্ডল বলে এক কিশোরকে খুনের দায়ে হোমে ঠাঁই হয় সুদীপ্ত বৈরাগী ও বিশ্বজিৎ বৈরাগী নামে দুই ভাইয়ের। হোম থেকে বেরিয়ে সুমন্ত বেশির ভাগ সময়ে হাবড়ায় সুদীপ্ত-বিশ্বজিৎদের বাড়িতেই থাকত। পুলিশের ধারণা, কোনও পুরনো শত্রুতার জেরে বৈরাগী দম্পতিকে খুনের জন্য সুমন্তকে কাজে লাগিয়েছে স্থানীয় একটি দুষ্কৃতী চক্র।

সুমন্ত হোম থেকে বেরনোর পরে তার উপরে ঠিকঠাক নজরও রাখা হয়নি বলে সরকারি সমাজকল্যাণ দফতরের আধিকারিকরাই ঠারেঠোরে মানছেন। কেন সুমন্তকে এ ভাবে অবহেলা করা হল? ওই ছেলেটি ছাড়া পাওয়ার পরে এক বছর পর্যন্ত জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের প্রোবেশনার অফিসার মনোজকুমার রায়কে তার উপরে নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বলে হোম সূত্রের খবর। ফলে এখন তাঁর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

পুলিশ জানতে পেরেছে, সুমন্ত হোম থেকে বেরিয়ে পড়াশোনা কার্যত ছেড়েই দিয়েছিল। কিছু দিন কলকাতার ধর্মতলার একটি পানশালায় কাজ করছিল। তার বাবাই কাজ খুঁজে দিয়েছিলেন। কিন্তু সুমন্ত কাদের সঙ্গে মিশছে, কোথায় থাকছে— সে বিষয়ে পরিবারের লোকজনের পাশাপাশি সমাজকল্যাণ দফতর কিংবা জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড, কারও কাছে খবরই ছিল না। কেন এমন হল? বোর্ডের প্রোবেশনার অফিসার মনোজবাবুর অবশ্য দাবি, সুদীপ্ত এবং বিশ্বজিৎকে এক বছরের জন্য তাঁর কাছে আসার কথা বলা হলেও সুমন্ত বিশ্বাসের কোনও দায়িত্ব তাঁর হাতে দেওয়া হয়নি। তবে হোমের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট জানিয়েছেন, সুমন্তের মা-বাবাও ছেলের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করেননি। হোমে ছেলে থাকাকালীন বার বার তার মা-বাবাকে আসতে বলা হলেও তাঁরা আসতেন না। তিন বছরে মাত্র এক বার সুমন্তের মা এসেছিলেন বলেই হোমের তরফে দাবি। যদিও বাবা-মায়ের বক্তব্য, ছেলে তাঁদের কথা শুনত না। বাড়ি ফেরার পরে ছেলেদের কী ভাবে নজরে রাখতে হবে সে বিষয়ে অভি‌ভাবকদেরও ঠিকঠাক পরামর্শ দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।

সুমন্তের মধ্যে অপরাধের বীজটা যে থেকে গিয়েছিল এখন মানছেন সমাজকল্যাণ দফতরের অনেক আধিকারিকই। কেউ কেউ ওর মধ্যে খানিকটা সজল বারুইয়েরও ছায়া দেখছেন। নাবালক সজল তার বাবা, সৎ মা, সৎ ভাইকে খুন করার পরে অনেক দিন জেলে কাটিয়ে ক্রমশ দাগি দুষ্কৃতীতে পরিণত হয়। জেল থেকে বেরিয়ে অপহরণ, ডাকাতির একাধিক মামলায় তার নাম জড়ায়। ফের জেলেই তার গতি হয়। অথচ সজলের ছবি আঁকার ক্ষমতা বা বাঁশি বাজানোর প্রতিভায় জেলের বিভিন্ন আধিকারিকেরা মুগ্ধ হয়েছেন বার বার। কিন্তু ছেলেটি কোনও দিনই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। কলকাতার জে জে বোর্ডের এক প্রাক্তন সদস্যের আক্ষেপ, ‘‘দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এখনও সরকারি হোমের পরিবেশ বা পরিকাঠামো নাবালক অপরাধীদের সংশোধনের পক্ষে অনুকূল হয়ে উঠতে পারেনি। আর তার মাসুল দিচ্ছে, সুমন্তের মতো ছেলেরা।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Barun Biswas Sumanta Minor accused Home
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE