মোদী ঝড়ে ধরাশায়ী বাম।
ঝড়ের পূর্বাভাস আগে থেকেই ছিল। মোদী ঝড়ে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক ও কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রে ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় বিজেপির শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে ভালই। তাই সারা রাজ্যের মতো পদ্ম কাঁটায় পূর্বেও ব্যাকফুটে বাম।
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তমলুক কেন্দ্রে বিজেপির ভোট ছিল মাত্র ১.৭৯ শতাংশ। এবার তা বেড়ে হয়েছে ৬.৪৪ শতাংশ। গতবার এই কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী পেয়েছিল ২০ হাজার ৫৭৩ ভোট। এবার তা বেড়ে হয়েছে ৮৬ হাজার ২৬৫ ভোট। একইভাবে, কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রেও ২০০৯ সালের নির্বাচনে বিজেপির ভোট ছিল মাত্র ২.৮৪ শতাংশ। এবার তা বেড়ে হয়েছে ৮.৬০ শতাংশ। গতবার এই কেন্দ্রে বিজেপি পেয়েছিল ৩১ হাজার ৯৫২টি ভোট। এবার তা বেড়ে হয়েছে ১ লক্ষ ১১ হাজার ৮২ ভোট।
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল, কংগ্রেস ও এসইউসি’এর জোট ভোটে লড়েছিল। এবার তৃণমূল এককভাবে ভোটে লড়াই করেছে। তবে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট গত বারের মতো প্রায় একই রয়েছে। ২০০৯ সালে তমলুক লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল, কংগ্রেস ও এসইউসি’র জোট প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী ৫৫.৫৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। এবার তৃণমূল এককভাবে লড়াই করে পেয়েছে ৫৩.৫৬ শতাংশ ভোট। কংগ্রেস প্রার্থী পেয়েছে ২.২১ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ, এবার কংগ্রেস ও তৃণমূলের পৃথকভাবে প্রাপ্ত ভোটের যোগফল গতবারের জোট প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের থেকে সামান্য বেশি।
অন্য দিকে, গতবার তমলুক লোকসভা কেন্দ্রে সিপিএম প্রার্থী লক্ষ্মণ শেঠ ৪০.৪৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। এবার সিপিএম প্রার্থী ইব্রাহিম আলি পেয়েছেন ৩৫.১৫ শতাংশ ভোট। গতবারের চেয়ে এবার লোকসভা নির্বাচনে তমলুকে বামেদের প্রাপ্ত ভোটের হার কমেছে প্রায় ৫ শতাংশের বেশি। একইভাবে, কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রে গতবার নির্বাচনে তৃণমূল জোট প্রার্থী শিশির অধিকারী পেয়েছিলেন ৫৩.৯৬ শতাংশ ভোট। এবার নির্বাচনে এককভাবে লড়াই করা তৃণমূল প্রার্থী শিশিরবাবু পেয়েছেন ৫২.৪১ শতাংশ ভোট। আর কংগ্রেস পেয়েছে ২.১০ শতাংশ ভোট। ফলে এক্ষেত্রেও গতবারের জোট প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট থেকে এবারে কংগ্রেস ও তৃণমূল প্রার্থীর পৃথকভাবে প্রাপ্ত ভোট সামান্যই বেশি।
কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রেও বামেরা বিপর্যয়ের মুখোমুখি। গতবারের থেকে এখানে বাম প্রার্থী ৭.৮৫ শতাংশ ভোট কম পেয়েছেন। অন্য দিকে, এই কেন্দ্রে বিজেপির ভোট শতাংশ বেড়েছে প্রায় ৬ শতাংশ। কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে কাঁথি দক্ষিণ, চণ্ডীপুর ও রামনগর বিধানসভা কেন্দ্রে প্রাপ্ত ভোটের শতাংশের হিসেবে কম ভোট পেয়েছে তৃণমূল। এবার তৃণমূল দক্ষিণ কাঁথি বিধানসভা কেন্দ্রে ৮.১৮ শতাংশ, চণ্ডীপুর বিধানসভা কেন্দ্রে ৫.৯৩ শতাংশ ও রামনগর বিধানসভা কেন্দ্রে ৫.০৩ শতাংশ ভোট কম পেয়েছে। তৃণমূলের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক মামুদ হোসেন বলেন, “কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান গতবারের থেকে এক লক্ষেরও বেশি বেড়েছে। তবে গতবারের থেকে ভোটদানের হার এবারে প্রায় ৪ শতাংশ কমায় ভোট শতাংশে হেরফের হয়েছে।”
বাম জমানায় সিপিএমের দুগর্র্ হিসেবে পরিচিত খেজুরিতেই সিপিএম এবার পর্যুদস্ত হয়েছে। তৃণমূল প্রার্থী শিশির অধিকারী খেজুরিতেই সিপিএম প্রার্থী তাপস সিংহকে ৩৮ হাজার ২৬৩ ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন। সিপিএম গত লোকসভা ভোটে খেজুরিতে ৪৮.০৩ শতাংশ ভোট পেলেও এবারে সেখানে তারা পেয়েছে মাত্র ৩২.৭১শতাংশ ভোট। গতবারের চেয়ে সিপিএম এবার খেজুরিতেই ১৫.৩২ শতাংশ ভোট কম পেয়েছে। এছাড়া পটাশপুর বিধানসভায় গতবারের চেয়ে ১০.৬৯ শতাংশ, দক্ষিণ কাঁথি বিধানসভায় ৮.১২ শতাংশ, কাঁথি উত্তরে ৭.৩২ শতাংশ ও ভগবানপুর বিধানসভা কেন্দ্রে গতবারের চেয়ে ৯ শতাংশ ভোট কম পেয়েছে বামেরা।
বিজেপির শক্তি বৃদ্ধিতে বামেদের ভোট ব্যাঙ্কে আরও ক্ষয়ের কথা স্বীকার করে সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নিরঞ্জন সিহি বলেন, “আমাদের দলের থেকে একাংশ সরে গিয়ে বিজেপিকে সমর্থন করেছে। আর একাংশ তৃণমূলকে সমর্থন করেছে। তবে তৃণমূলের একাংশও বিজেপিকে সমর্থন করেছে। তবে বাম ভোটারদের একাংশ আবার তৃণমূলকে সমর্থন করায় তৃণমূলের ভোট ব্যাঙ্ক অক্ষুন্ন রয়েছে। তবে আমাদের ভোট কমার কারণ মূল্যায়ন করে দেখা হবে। নিরঞ্জনবাবুর অভিযোগ, “নন্দীগ্রাম, হলদিয়া, ময়না,ভগবানপুর-সহ জেলার বেশ কিছু এলাকায় বুথ দখল করে ছাপ্পা ভোট দেওয়ায় তৃণমূলের ভোটের হার এতটা হয়েছে।” সিপিএমের ভারপ্রাপ্ত জেলা সম্পাদক প্রশান্ত প্রধান বলেন, “গত লোকসভা ভোটে কাঁথি কেন্দ্রে সিপিএম প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট এবারেও প্রায় একই রয়েছে। তরুণ প্রজন্মের ভোটাররা বামেদের থেকে বিমুখ থাকায় ভোট শতাংশ কমেছে।”
অন্য দিকে, বিজেপি’র জেলা সাধারণ সম্পাদক সুকুমার দাসের দাবি, জেলায় দলীয় প্রার্থীরা আরও বেশি ভোট পেত। কিন্তু তৃণমূল কর্মীরা নন্দীগ্রাম, হলদিয়া, খেজুরিতে আমাদের দলের কর্মী-সমর্থকদের উপর আক্রমণ করে, হুমকি দিয়ে ভোট দিতে বাধা দিয়েছিল। তা না হলে আমাদের দলের প্রতি জনসমর্থনের হার আরও অনেকটাই বৃদ্ধি পেত। সুকুমারবাবু বলেন, “মোদী ঝড় তো এখানে আছেই। তাই বামফ্রন্টের একাংশের পাশাপাশি রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের দুর্নীতিমূলক কার্যকলাপের প্রতিবাদ জানাতে ওই দলের বহু সমর্থক আমাদের দলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তৃণমূলের সন্ত্রাস সত্ত্বেও আমাদের দলের প্রতি যেভাবে সাধারণ মানুষ সমর্থন করেছেন, তা বেশ আশাপ্রদ।” বিজেপির জেলা সভাপতি তপন কর বলেন, “বিজেপির ভোট আরও বাড়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ভোটের দিন শাসকদলের ছাপ্পা, রিগিংয়ের কারণে মানুষের রায় যথার্থভাবে প্রতিফলিত হয়নি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy