Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

ঝুলকালি মেখে সম্ভ্রম বাঁচাতেন গ্রামের মেয়েরা

মূর্তির মতোই নির্যাতন, প্রতিবাদ, প্রতিরোধের স্মৃতি বয়ে চলেছে তিনটি গ্রাম। এবং তাঁরা এখনও সম্মান করেন নির্যাতিতদের সংগ্রামকে।

স্মৃতি: মা হিরণবালার ছবি হাতে শ্রীমন্ত কুইলা। নিজস্ব চিত্র

স্মৃতি: মা হিরণবালার ছবি হাতে শ্রীমন্ত কুইলা। নিজস্ব চিত্র

আরিফ ইকবাল খান
শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৮ ০২:৪২
Share: Save:

ছুরি হাতে এক মহিলা। বাম পা সামনের দিকে এগিয়ে রাখা। ডানহাতে উদ্যত ছুরি উপরের দিকে তোলা। বাম হাতে একটা দণ্ড। ভঙ্গিটা মারমুখী। আসলে প্রতিরোধের, প্রতিবাদের প্রতীক একটি মূর্তি। এক বিশেষ দিনের ইতিহাস বয়ে নিয়ে চলেছে নারীমূর্তিটি। তমলুক রাজ্য সড়কে মহিষাদলের লক্ষ্যার পাশেই রয়েছে মূর্তিটি। আর কিছুটা এগোলেই তিনটি গ্রাম পড়বে। মাশুড়িয়া, ডিহি মাশুড়িয়া, চণ্ডীপুর গ্রাম। এই তিনটি গ্রামেই ১৯৪৩ সালের ৯ জানুয়ারি ব্রিটিশ পুলিশ ৪৬ জনকে ধর্ষণ করে।

মূর্তির মতোই নির্যাতন, প্রতিবাদ, প্রতিরোধের স্মৃতি বয়ে চলেছে তিনটি গ্রাম। এবং তাঁরা এখনও সম্মান করেন নির্যাতিতদের সংগ্রামকে। ডিহি মাশুড়িয়ার হিরণবালা কুইলা, কিশোরীবালা কুইলা, রাসমণি পাল-সহ ১১ জনের বাড়ি ছিল এখানে।

জীর্ণ এক কাঁচা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন তিন বৃদ্ধা— অন্নপূর্ণা কুইলা, চপলরানি কুইলা এবং প্রজাপতি কুইলা। এই তিন জনেই অশীতিপর। এই বাড়িতে ঢুকেও অত্যাচার করেছিল ব্রিটিশ বাহিনী। গোটা পাড়া তখন হাজির এই বাড়িটার সামনে। অন্নপূর্ণারা জানান, তাঁদের গ্রামের মহিলাদের লড়াই সত্যি রূপকথার মত। পুরুষ শূন্য গ্রামে ব্রিটিশদের অত্যাচার ছিল লাগামছাড়া। বাড়ি বাড়ি ফর্সা সুন্দর মেয়েদের খুঁজত তারা। মহিলারা অনেকেই প্রতিরোধ করতেন। যাঁরা প্রতিরোধ করতেন তাঁদের কপালে জুটত বন্দুকের বাট দিয়ে মার। অনেককেই পঙ্গু করে দিয়েছিল ব্রিটিশ বাহিনী। প্রজাপতি বলেন, ‘‘আমার শাশুড়িমা কিরণবালা কুইলার কাছে গল্প শুনেছি ওদের হাত থেকে বাঁচতে কালিঝুলি মেখে বসে থাকতেন। কালো মেয়ে বাহিনীর অপছন্দ ছিল।’’

কিশোরী কুইলার কাছে নির্যাতনের কথা শুনেছেন, নৃশংসতার কথা শুনেছেন অন্নপূর্ণারা। তিনি বলেন, ‘‘কিশোরী ছিলেন বাঘিনীর মত সাহসী। তাই বন্দুক নলের সামনেই চলেছিল নির্যাতন। কিন্তু কিশোরীর সাহস দেখে ব্রিটিশদেরও বুক কেঁপে গিয়েছিল। তাঁকেও বিপ্লবী হিসেবে ধরে নিয়েও চলেছিল অত্যাচার।’’

মোহনদাস কর্মচাঁদ গাঁধী ১৯৪৫ সালে এসেছিলেন মহিষাদলের একতারপুরে। সেই সময় গাঁধীর সংস্পর্শে এসেছিলেন কিশোরী কুইলা। কিশোরীর কাছে গাঁধী ছিলেন ‘গাঁধীবাবু’। কিশোরীবালার পরিবারের প্রবীণ সদস্য নারায়ণচন্দ্র কুইলা জানান, বেঁচে থাকা অবধি কোনও সম্মান পাননি। ৩০০ টাকা মাসে পেনশন পেতেন। ওই গ্রামের বাসিন্দা সুব্রত মাইতি বলেন, ‘‘আমার ঠাকুমা শৈলবালা মাইতি ছিলেন বিধবা। সেই সময় গ্রামের মহিলাদের অত্যাচার থেকে বাঁচাতে সবাইকে নিয়ে বঁটি, ছুরি ও কাটারি হাতে নিয়েই অপেক্ষা করছিলেন। মেয়েদের সেই মূর্তি দেখে পুলিশ বাড়িতে এলেও পালিয়ে যায়।’’

রেলবাঁধের কাছে চণ্ডীপুরে দেখা মেলে বছর নব্বইয়ের উষারানী রায়ের সঙ্গে। বৃদ্ধা মনে করতে পারেন গাঁধীজির জন্য মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কথা। থানা দখল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। খালি পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বার্ধক্য ভাতা বা কোনও সাহায্য পাননি। গ্রামের তরুণদের কেউ কেউ গ্রামের নির্যাতিতাদের নিয়ে হলদিয়া যেতেন। ৩০০ টাকার পেনশন আনতে। হলদিয়ায় ট্রেজারি থেকে আবার ব্যাঙ্কে। সুশীল ধাড়ার একসময়ের সহকর্মী অনন্ত বাসুদেব মাইতি নির্যাতিতাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে দিয়েছিলেন। যদি কেউ তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন সেই আশা থেকে। এখন নির্যাতিতাদের কেউ বেঁচে নেই। কিন্তু বেঁচে থাকার সময়েই তাঁদের খোঁজখবর তেমন কেউ রাখত না। আক্ষেপ আরও আছে। স্থানীয় বাসিন্দা নাট্যকার অলোকেশ সামন্ত বললেন, ‘‘গর্ব এখানকার মানুষের জন্য। এঁদের বীরত্বের কথা, অবদানের কথা দেশবাসী আর জানলেন কই?’’

গ্রামে ঢোকার মুখের সেই মূর্তিটা সবকিছুর জানান দেয়! ইতিহাসের, নির্যাতন।

অন্য বিষয়গুলি:

Village women dignity British attack
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE