ভেজাল বিষে জর্জরিত পূর্ব মেদিনীপুর। রং মেশানো শাক-সব্জি, রাসায়নিকে ডোবানো ফল, হোটেল রেস্তোরাঁয় বিক্রি হওয়া বাসি মাছ-মাংস— অভাব নেই কোনও কিছুর। অবাধে চলছে অখাদ্যের ব্যবসা। কিন্তু খাদ্যের গুণগত মান পরীক্ষা বা ভেজাল খাদ্য বিক্রি বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা যে দফতরের, সেখানেই কর্মী সঙ্কট। ফলে শিকেয় উঠেছে নজরদারি। ৩০ জন খাদ্য সুরক্ষা আধিকারিকের জায়গায় রয়েছেন মাত্র একজন। পশ্চিমের অবস্থা আরও খারাপ। পূর্বের খাদ্য সুরক্ষা আধিকারিককেই অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে দেখতে হয় পশ্চিম মেদিনীপুরও।
ভেজাল প্রতিরোধের জন্য জেলা স্বাস্থ্য দফতরের অধীনে খাদ্য সুরক্ষা বিভাগ রয়েছে। রয়েছেন খাদ্য সুরক্ষা আধিকারিকও। কিন্তু গত চার বছর ধরে চলা কর্মীসঙ্কটে সে বিভাগটি প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়েছে। ফলে একদিকে যেমন খাদ্যের গুণগত মান পরীক্ষা বা ভেজাল প্রতিরোধ অভিযান বন্ধ পড়েছে, তেমনই মুখ থুবড়ে পড়েছে খাদ্য বা খাদ্যবস্তু বিক্রি করার অনুমতি (ফুড লাইসেন্স) দেওয়ার কাজও। ফলে, রাজ্য সরকারের ক্ষতি হচ্ছে নিয়ম করে। ফুড লাইসেন্স ইস্যু না-হওয়ায় প্রতি বছর কোটি টাকারও উপর রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে জেলা স্বাস্থ্যদফতর ও রাজ্য সরকারের।
পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক নিতাইচাঁদ মণ্ডল গোটা বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনিই জানালেন, জেলা স্বাস্থ্য দফতরে এখন মাত্র একজন খাদ্যসুরক্ষা আধিকারিক রয়েছেন। পূর্ব মেদিনীপুরের পাশাপাশি তাঁকে পশ্চিম মেদিনীপুরের অতিরিক্ত দায়িত্বও পালন করতে হয়। নিতাইবাবুর দাবি, ‘‘জেলায় পর্যাপ্ত খাদ্য সুরক্ষা আধিকারিক না থাকার ফলেই জেলায় খাদ্য সুরক্ষা অভিযান ও লাইসেন্স ইস্যু করা নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। জেলা স্বাস্থ্য দফতরের পক্ষ থেকে বারবার ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে লাভ হয়নি। আমরা কার্যত অসহায়।” সে কথা স্বীকার করেছেন, পশ্চিম মেদিনীপুরের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরিশচন্দ্র বেরাও।
নিয়ম অনুযায়ী, পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁচটি পুরসভা এবং ২৫টি পঞ্চায়েত সমিতির প্রতিটিতে একজন করে খাদ্য সুরক্ষা আধিকারিক থাকার কথা। অর্থাৎ মোট ৩০ জন খাদ্য সুরক্ষা আধিকারিক থাকার কথা। রয়েছেন মাত্র একজন। বাকি ২৯টি শূন্যপদে চটজলদি নিয়োগের কোন সম্ভাবনাও যে নেই তা বলাই বাহুল্য। একইভাবে পশ্চিম মেদিনীপুরে আটটি পুরসভা এবং ২৯টি পঞ্চায়েত সমিতি। অর্থাৎ ৩৭ জন খাদ্য সুরক্ষা আধিকারিকে জায়গাই খালি পড়ে রয়েছে।
কাঁথি মহকুমার সহকারী মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক চন্দ্রশেখর দাস বলেন, “স্বাস্থ্য দফতরের সহকারী মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকরা আগে বিক্রয়জাত খাদ্যের মান, গুণাগুণ পরীক্ষা করা বা ভেজাল খাদ্য বিক্রির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু বর্তমান আইনে তাঁদের সেই ক্ষমতা নেই। ফলে সবকিছু দেখে শুনেও আমাদের কিছুই করার নেই।”
জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১১ সালের আগে রাজ্যে ‘খাদ্য ভেজাল প্রতিরোধ আইন’ চালু ছিল। সেই আইন অনুসারে পুরসভাগুলি খাদ্য লাইসেন্স ইস্যু করত, স্বাস্থ্য দফতরের তত্ত্বাবধানে নিজেদের এলাকায় খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ ও খাদ্যের গুণাগুণ পরীক্ষার কাজও চালাতো। পুরসভার বাইরে স্বাস্থ্য দফতরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হত ভেজাল প্রতিরোধ অভিযান। কিন্তু ২০০১১ সালের ৫ অগস্ট খাদ্য নতুন ‘খাদ্য সুরক্ষা আইন’ চালু হয়। নতুন আইন অনুসারে লাইসেন্স ইস্যু করা বা পুনর্নবীকরণ থেকে গুণগত মান পরীক্ষা ও ভেজাল খাদ্য বিক্রি বন্ধ— সব দায়িত্ব গিয়ে পড়ে স্বাস্থ্য দফতরের হাতে। খোলা হয় ‘খাদ্য সুরক্ষা’ বিভাগও।
জেলার প্রতিটি পুরসভা এলাকা আর ব্লক এলাকা পিছু একজন করে খাদ্য সুরক্ষা আধিকারিককে গোটা বিষয়টি দেখভাল করার দায়িত্বও দেওয়া হয়। ২০১২ সাল থেকেই পূর্ব মেদিনীপুরে খাদ্য সুরক্ষা আধিকারিকের সংখ্যা কমতে শুরু করে বলে দফতর সূত্রে খবর। গত তিনবছরে তা মাত্র একে এসে দাঁড়িয়েছে। জেলার একমাত্র স্বাস্থ্য আধিকারিক কালীপদ জানা বলেন, ‘‘২০১৪ সালে উত্তরবঙ্গ থেকে বদলি হয়ে পূর্ব মেদিনীপুরে এসেছিলাম। তারপর থেকে দুই জেলার কাজই দেখতে হচ্ছে। কাজের চাপ বেশি থাকায় স্বাভাবিকভাবেই কিছু অসুবিধা হচ্ছে।’’
স্বাস্থ্য দফতরের অন্য এক কর্তার কথায়, ‘‘ওষুধ ছাড়া আর সমস্ত রকমের খাদ্য বা খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করতে খাদ্য লাইসেন্সের প্রয়োজন হয়। এমনকী ফুটপাত বা ঠেলায় করে বিক্রি করা খাবার, সব্জি থেকে হোটেল রেস্তোরাঁর এমনকী শিশুখাদ্য বিক্রির জন্যও খাদ্য সুরক্ষা বিভাগের অনুমতির প্রয়োজন হয়। প্রতিটি লাইসেন্স বাবদ রাজ্য সরকার ১০০ টাকা ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ‘ফি’ আদায় করে রাজস্ব হিসাবে। গত তিন বছর ধরে সেই রাজস্ব আদায়ও হচ্ছে না। নতুন লাইসেন্স ইস্যু বা পুনর্নবীকরণ না হওয়ার ফলে প্রতি বছর জেলায় কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব ফাঁকি পড়ছে।
তবু হুঁশ নেই রাজ্য সরকারের।
তথ্য সহায়তা: বরুণ দে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy