শম্ভু সিংহ(দুবরাজপুর)
গ্রামের সকলে মিলেমিশে ভালই কাটছিল দিনগুলো। পরবে আনন্দ, কেউ সমস্যায় পড়লে সকলে ঝাঁপিয়ে পড়ত, কারও বাড়ি খাবার কম পড়লে দিয়েও যেত পাশের বাড়িরে লোকেরা। সব কেমন যেন গুলিয়ে গেল গ্রামেরই থোবা সিংহের ছেলে জিতেন মরে যাওয়ার পর।
খুব মদ খেত ছেলেটা। বাড়ি ফিরে অশান্তি করত। হঠাৎ একদিন দুপুর থেকে শুরু হল পেট ব্যথা। এখানে তো অত শহরের মতো ডাক্তার-বদ্যি নেই। আমরাই অনেক রকম ভাবে চেষ্টা করেছিলাম, ছেলেটাকে বাঁচানোর। কিন্তু হল না। একদিন মরে গেল ছেলেটা। আর তারপরই থোবা, ওর বৌ বাসন্তী আর বৌমা সুমিত্রা কেমন যেন বদলে গেল। খালি ছেলেটার মরে যাওয়ার পর দোষারোপ করতে শুরু করল পড়শি ফুলমণি আর তাঁর মেয়ে শম্বারীকে। তাই নিয়ে লেগে থাকত রোজদিনের অশান্তি। এমনকী ওদের গায়ে হাত তুলতেও কসুর করত না থোবারা। তবে রুখে দাঁড়িয়েছিল শম্বারী বর লক্ষ্মীকান্ত। একদিন মাটিতে ফেলে কী মারটাই না মারল থোবাকে।
তাতেই আরও খেপে গেল থোবা। প্রতিশোধ নিতেই একটা নতুন ছক কষে থোবা। তার সঙ্গে যোগ দেয় গ্রামের মাতব্বরাও। ফুলমণি আর ওর মেয়েকে শায়েস্তা করতে গ্রামের লোকদের জড়ো করে। গ্রামে ছড়িয়ে দেয় যে ওরা না কি ডাইন। আর জিতেনের মতোই যারা রোগে ভুগছে সেটার কারণ ওই ডাইনদের নজর। কী জানেন তো, আমাদের সমাজে তো জানগুরুদের উপর একটা দুর্বলতা রয়েছে তো! ফুলমণি ঠিক ডাইন কি না তা জানতে গ্রামের মানুষ ছুটে গিয়েছিল গড়বেতার ওই জানগুরুর কাছে। ওদের উস্কেছিল থোবা সিংহই। ওদের সঙ্গেই গিয়েছিল স্থানীয় হরিরাজপুরের বধূ শম্বরীও। কিন্তু এমনই কপাল, ফুলমণি-শম্বারীর সঙ্গে শম্বরীকেও ডাইন ঠাহর করে জানগুরু।
আর যায় কোথায়! এমন নিদান শোনার পর ওধের মারতে শুরু করে গ্রামের মহিলারা। গ্রামের মাতব্বরও ওদের মারধর করে। তারপরই গ্রামে বসল সালিশি। দিনটা ছিল ২০১২ সালের ১৬ অক্টোবর। ওই দিন সকাল থেকেই শুরু হয় সালিশি। ওদের নিয়ে কী করা হবে তা ঠিক করতে করতে পেরিয়ে গিয়েছে বিকেল। ঠিক হয় ৬০ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে গ্রাম ছাড়তে হবে ফুলমণি-শম্বারী আর পাশের গ্রামের শম্বরীকে। ফুলমণিদের পাশে তখন আমি আর আমার আত্মীয়রা। মাথা নেড়ে ফুলমণি জানিয়ে দিয়েছিল ওরা টাকা দিতে পারবে না। তাই শুরু হল মার। আমাদের চোখের সামনেই চুলের মুঠি ধরে রাস্তায় ফলে বাঁশ দিয়ে পেটানো শুরু হয়। আমরা বাধা দিতে গেলে চলে যেতে নির্দেশ দেয় বলে থোবা আর ও শাগরেদরা।
আমি বাড়ি ফিরলেও গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল বুধু-বোবা আর লক্ষীকান্তদের। রাতেই শুনেছিলাম গ্রামের সকলে ওই তিনজনেরই মাথার চুলও কেটে দিয়েছিল। পরে বাঁশ দিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে মারতে টেনে নিয়ে গিয়েছিল কংসাবতীর তীরে। জামাকাপড় টেনে খুলে দিয়েছিল ওরা। মেরে ফেলেও শান্তি পায়নি ওই বদমাইশগুলো। নদীর চরে গর্ত করে পুঁতে দিয়েছিল দেহগুলো। শুনেছিলাম পাশের গ্রামের কয়েকজন দায়পুর থানায় খবর দিয়েছিল।
পুলিশ এসেছিল পরের দিন সকালে। গ্রামের এক মহিলার কাছ থেকেই খবর পেয়ে নদীর চরে গিয়ে মেলে দেহগুলো। ততক্ষনে দেখি বহু মানুষের ভিড়। পুলিশ দেহগুলো নিয়ে চলে যায়। জানগুরুকে শাস্তি দিয়েছে আদালত। কিন্তু আসল অপরাধী তো ওই থোবা ওর বৌ বাসন্তী আর বৌমা সুমিত্রা। ওদের যেন পুলিশ খুব তাড়াতাড়ি ধরতে পারে। ওই থোবাই তো নাটের গুরু। ওদের আদালত ফাঁসির নির্দেশ দিলে তবে ফুলমণিরা শান্তি পাবে!
(অনুলিখন: অভিজিৎ চক্রবর্তী)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy