আজও ক্ষুদিরামের জন্মভিটেতে তৈরি হল না সংগ্রহশালা (বাঁ দিকে)। অবহেলায় ধুঁকছে মোহবনির গ্রন্থাগারও (ডান দিকে)।
অবহেলায় হারাতে বসেছে মোহবনির বিস্ময় বালকের সংগ্রামের ইতিহাস।
ব্রিটিশদের দেশ থেকে হঠাতে যিনি ফাঁসির দড়ি গলায় পরতেও কুণ্ঠা বোধ করেননি, সেই ক্ষুদিরামের জন্মস্থান মোহবনিতে আজও গড়ে ওঠেনি কোনও সংগ্রহশালা। মোহবনির গ্রন্থাগারের আনাচে-কানাচেও অবহেলার ছাপ স্পষ্ট। শহিদ ক্ষুদিরাম স্মৃতিরক্ষা সমিতির সভাপতি চিত্তরঞ্জন গরাই মানছেন, মোহবনিতে ক্ষুদিরামের স্মৃতিতে সংগ্রহশালা গড়ে তোলাটা জরুরি। তাঁর কথায়, “অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। এ বার কিছু একটা করতেই হবে। আমরা এই সংগ্রহশালা গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিচ্ছি। রাজ্য সরকারের কাছে প্রস্তাবও পাঠাচ্ছি।”
সময়টা পঞ্চাশের দশক। কেশপুরের মোহবনিতে ক্ষুদিরাম বসুর জন্মভিটে সংরক্ষণে এগিয়ে আসেন হরিসাধন চক্রবর্তী, বঙ্কিমবিহারী রায়, মইনুদ্দিন চৌধুরী, মদনমোহন রায়, পাঁচকড়ি মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। গড়ে উঠল শহিদ ক্ষুদিরাম স্মৃতি রক্ষা সমিতি। শুরু হল ক্ষুদিরামের জন্ম ও মৃত্যুদিন পালন। আজও ওই দু’টি দিনে কিছু কর্মসূচি পালন করা হয়। সেই সময় কিছু মানুষ গ্রন্থাগারের আলমারির ধুলো মাখা কাঁচে উঁকিঝুঁকি দেন। শহিদ স্মরণ বলতে ব্যস ওইটুকুই। মেদিনীপুরের সীমানা ছাড়িয়ে রাজ্য তথা দেশের কাছে ক্ষুদিরামকে তুলে ধরার কোনও প্রচেষ্টা চোখে পড়েনি। অনাদরে হারাতে বসেছে ক্ষুদিরামের ব্যবহৃত নানা স্মৃতি বিজরিত জিনিসও।
স্মৃতি রক্ষা সমিতির সম্পাদক রামচন্দ্র সানিও মানছেন, “ক্ষুদিরাম বসুর ব্যবহার্য জিনিসপত্র সংরক্ষণ করে রাখা যেতে পারে এখানে। বিষয়টি আমাদের নজরে রয়েছে।” তাঁর কথায়, “এ ক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দের জন্য আবেদনও করা হবে।” বছর চারেক আগে সমিতিকে দশ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। সেই অর্থে একটা ঘরও নির্মাণ করা হয়েছে। এই ঘরেই চলে সমিতির কাজকর্ম। মোহবনিতে শিশু উদ্যান রয়েছে। অথচ, উদ্যানের নিয়মিত দেখভাল হয় না। স্থানীয়দের মতে, সময়ের স্রোতে বহু ইতিহাস লোপাট হয়ে গিয়েছে। বহু নিদর্শন ধুলোয় মিশে গিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা অলোক বসু বলছিলেন, “মোহবনির ইতিহাস নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি। কিন্তু, এই ইতিহাসকে ধরে রাখা বা প্রচারের জন্য সরকারি স্তরে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।” স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, সামান্য যা কিছু নিদর্শন রয়েছে, তাও সময়ের থাবায় হারিয়ে যাবে না তো? মেদিনীপুরের (সদর) মহকুমাশাসক অমিতাভ দত্তের আশ্বাস, “মোহবনিকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে পদক্ষেপ করা হবে।”
ছাত্রবস্থাতেই প্রত্যক্ষ স্বদেশি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন ক্ষুদিরাম। একদিন হঠাৎ বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যান তিনি। আশ্রয় নিলেন তাঁর বিপ্লবীগুরু সত্যেন্দ্রনাথ বসুর তাঁতশালায়। আসলে এটি ছিল বিপ্লবীদের একটি গুপ্ত আখড়া। কিংসফোর্ড ইংরেজ সরকারের কুখ্যাত বিচারক। কিংসফোর্ডকে খতম করার দায়িত্ব বর্তায় ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকির উপর। তারপরের ইতিহাস আপামর ভারতবাসীর স্মৃতিতে সতেজ।
মোঘলযুগের আফগানশাসক শেরশাহের ভূমিরাজস্ব আদায়ের জন্য তৈরি ভঞ্জভূম ও ব্রাহ্মণভূম পরগনার যুক্ত অংশই হল আজকের কেশপুর। তমাল নদী এই দুই পরগনার সীমানা নির্ধারণ করেছে। ষোড়শ শতকের আকবরের পার্ষদ ও ঐতিহাসিক আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’-তে এই পরগনাগুলোর উল্লেখ রয়েছে।
মধ্যযুগে বর্ধমানের ডিহিদার কর্তৃক অত্যাচারিত হয়ে কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ব্রাহ্মণভূম পরগনার আড়রাবাগে উপস্থিত হন। এই পরগনার তৎকালীন জমিদার বাঁকুড়া রায়ের পুত্র রঘুনাথ রায়ের গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। এই এলাকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনধারার উপর ভিত্তি করেই তিনি রচনা করেন অন্যতম কাব্য ‘চণ্ডীমঙ্গল’। কেশপুরের অযোধ্যাবাড়ে রামেশ্বর ভট্টাচার্য অমূল্য গ্রন্থ ‘শিবায়ন’ রচনা করেন। অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী হিরন্ময়ীদেবীর (ডাকনাম মোক্ষদা) পিত্রালয় ছিল শ্যামচাঁদপুর। পেশাগত প্রয়োজনে কাঠমিস্ত্রীর কাজে এই এলাকার অনেকে রেঙ্গুনে যান। এঁদেরই একজন কৃষ্ণদাস অধিকারীর কন্যা ছিলেন হিরন্ময়ীদেবী।
কেশপুরের কানাশোলে রয়েছে ঝাড়েশ্বরের শিব মন্দির। মন্দিরটি পঞ্চরত্ন রীতির এবং দেওয়ালে রামায়ণ ও কৃষ্ণলীলা বিষয়ক পোড়ামাটির ফলক নিবদ্ধ রয়েছে। ভোগঘরটি আটচালা রীতির। ভোগঘরটিতে নিবদ্ধ এক প্রতিষ্ঠালিপি থেকে জানা যায় যে, এটি ১৮৫১ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত। ধলহারায় বটেশ্বর শিবের মন্দির ওড়িশা স্থাপত্যশৈলীর জনশ্রুতি যে কর্ণগড়ের রাজা যশোমন্ত সিংহ এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। কেশপুরের শ্যামচাঁদপুরের পাশে আড়রাগড়ের ধ্বংসাবশেষ আজও রয়েছে।
দিন বদলেছে। বদলেছে কেশপুরও। বছর দশেক আগে এখানে কলেজ গড়ে উঠেছে। শুরু হয়েছে ইংরেজি মাধ্যম মাদ্রাসা তৈরির তোড়জোড়। জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ শ্যামপদ পাত্র বলেন, “রাজ্য সরকার মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে সব রকম চেষ্টা করছে। এই উদ্যোগ তারই একটি।” কেশপুরের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠছে নানা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। কোথাও স্পোকেন ইংলিশ শেখানো হয়। কোথাও কম্পিউটার শিক্ষা দেওয়া হয়। তৈরি হচ্ছে মার্কেট কমপ্লেক্স, আইটিআই, কিষান বাজার। তোড়িয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক উত্পল গুড়ে বলছিলেন, “কেশপুর অনেকটা এগিয়েছে। আগামী দিনে আরও এগোবে।” পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে কেশপুরে একটি মহিলা কলেজ খোলা নিয়েও ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। কেশপুর কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি চিত্তরঞ্জন গরাই বলেন, “কেশপুরে একটা মহিলা কলেজ হলে ভালই হয়। মোহবনির আশপাশে এই কলেজ করা যেতে পারে। নতুন কলেজ হলে শিক্ষার আরও
প্রসার হবে।” ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy