রাস্তার দু’পাশে শুধুই মাথা উচু করা ইউক্যালিপটাস। কোথাও বা শাল, আকাশমণি।
রাস্তা থেকে নেমে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকলেও কী দেখা মিলবে অশোক, রিঠা, পিয়ালের? উত্তরটা অবশ্যই ‘না’।
সারা জঙ্গল চষে বেড়ালে বড় জোর দু’চারটি পিয়াল, লেদা, রিঠা, আমলকি, হরিতকির দেখা মিলবে। তেমনই হারিয়ে যেতে বসেছে কালমেঘ, ঘৃতকুমারী, সর্পগন্ধা বা আলকুষিও। অথচ, আগে গ্রামে পথ চলার সময় সাবধান করে দেওয়া হত, ওদিকে সাবধানে যাস—আলকুষি গাছ রয়েছে। হওয়ায় উড়ে এসে ফলের তুষ গায়ে লাগালে জ্বালায় ছটফট করতে হবে।
এখন সে সব শুনলে রূপকথা মনে হবে। অথচ, ওই সব ওষধি গাছের গুরুত্ব অসীম। পশ্চিম মেদিনীপুরের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরা বলেন, ‘‘আমলকি, হরিতকি থেকে কালমেঘ, সর্পগন্ধা, আলকুষি, তুলসি এই সব গাছ ও গুল্মেই ভেষজ গুণ রয়েছে। নানা রোগ থেকে মুক্তি মেলে। এই সব গাছ থেকেই তো তৈরি হয় নানা ওষুধ।’’
অথচ, এই সব গাছই হারিয়ে যেতে বসেছে। তার প্রধান কারণ কী?
বন দফতরের মত, অবৈজ্ঞানিক ভাবে এই সব গাছ তোলা ও ওষধি চাষকে বাণিজ্যিক রূপ দেওয়ায় ব্যর্থতাতেই গাছগুলি হারিয়ে যেতে বসেছে।
সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠতেই এ বার কাজে নামতে চলেছে বন দফতর। শুধু বন দফতর নয়, সাধারণ মানুষকেও এই সব ওষধি গাছ লাগানোর জন্য এ বার উত্সাহ দেওয়া হবে।
দক্ষিণবঙ্গের তিনটি জেলাতে এই কাজ শুরু হচ্ছে চলতি বছরেই। পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া—তিনটি জেলার ৩০০ হেক্টর জমিতে এবার ওষধি গাছ লাগানো হবে। তার জন্য প্রাথমিক ভাবে ২০০ বন সুরক্ষা কমিটি চিহ্নিতও করে ফেলেছে বন দফতর। বন দফতর তিন ভাবে এই কাজ করতে চাইছে। বন দফতর নিজস্ব উদ্যোগে ৩০০ হেক্টর জমিতে চাষ করবে। তারপর জঙ্গল এলাকার স্ব-সহায়ক দল, বন সুরক্ষা কমিটি বা স্থানীয় মানুষ যদি মনে করেন, বন দফতরের জমিতে এই চাষ করবেন, সে সুযোগও তাঁদের দেওয়া হবে। বন দফতর যে গাছ লাগাবে, তার মাঝের ফাঁকা অংশে তাঁরা ওষধি গাছ লাগাতে পারবেন। এ ছাড়াও কেউ ব্যক্তিগত ভাবে নিজের জমিতেও চাষ করতে পারেন। প্রথমবার বীজ থেকে প্রযুক্তি সবই দেবে বন দফতর। আগামি দু’বছরের এই প্রকল্পে ৯ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা পেয়েছে বন দফতরের সিলভিকালচার শাখা (দক্ষিণবঙ্গ)।
কিন্তু প্রশ্ন হল, চাষ তো হবে, কিন্তু সাধারণ মানুষ বিক্রি করবেন কোথায়? লাভই বা হবে কেন? বাজার না পেলে নিরুত্সাহ হয়ে চাষ তো বন্ধ করে দেবেন সকলেই।
বন দফতরের কিন্তু দাবি, অন্য ফসলের চেয়ে ভেষজ চাষে লাভ অনেক বেশি। তা ছাড়াও ওষধি গাছ লাগানোর জন্য উর্বর জমিরও প্রয়োজন পড়বে না। কাঁকড়ে মাটিতেও হবে। জঙ্গলের মাঝেও লাগানো যায়। বন দফতরের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ‘প্রতি হেক্টর কালো তুলসি চাষ করলে ১ বছরে ৬১ হাজার ১২৮ টাকা ন্যূনতম লাভ মিলবে। সর্পগন্ধাতে ২ বছরে মিলবে ৫ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা। শতমূলে ১ বছরে মিলবে ন্যূনতম ২ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা।’ সিলভিকালচারের ডিএফও (দক্ষিণবঙ্গ) রবীন্দ্রনাথ সাহা বলেন, “বাজার তৈরির দায়িত্ব নেব আমরাই। চাষিদের এ ব্যাপারেও মাথা ঘামাতে হবে না।”
তার জন্যও বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়েছে বন দফতর। বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কথা যেমন চলছে, তেমনই বন দফতরের উদ্যোগেই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গোদাপিয়াশালে একটি ওষধি গাছ থেকে বিভিন্ন উপকরণ তৈরির কারখানাও তৈরি করবে। প্রত্যন্ত এলাকার চাষিরা গাছ থেকে নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে পাতা, মূল প্রভৃতি তোলার পর তা যাতে নষ্ট না হয় সে জন্য একাধিক রেঞ্জে বিশেষ ব্যবস্থাও থাকবে। সেখানে চাষিরা উত্পাদিত ওষধি গাছ নিয়ে এসে সংরক্ষণও করতে পারবেন। ডিএফও-র কথায়, “প্রথমবার চারা থেকে প্রযুক্তি সব আমরা দেব। লাভ পুরোটাই চাষিদের। পরের বার সেই লাভ থেকে নিজেদেরই চাষ করতে হবে চাষিদের। তবে বাজারের বিষয়টি দেখভাল করবে বন দফতরই।”
যা শুনে উত্সাহিত কৃষকেরাও অবশ্য বন দফতরের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। নয়াগ্রামের চাঁদাবিলা গ্রামের কৃষক নিলু সাহা, আমজামের অজয় মাইতি, বড় ধানশোলার বিজয় মাইতিরা বলেন, “আমাদের তো অভিজ্ঞতা নেই। তাই প্রথমে বন দফতরের সঙ্গে চাষ শুরু করেছি। লাভ দেখলে ব্যক্তিগত ভাবেও চাষ শুরু করব।” ইচ্ছুক চাষিরা ব্যক্তিগত ভাবে চাষ করতে চাইলেও বন দফতর চারা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করবেন বলে জানিয়েছেন। বন দফতর জানিয়েছে, যাতে এই প্রকল্প কোনও ভাবেই মাঝ পথে থমকে না যায় সে জন্য কারখানা তৈরি থেকে রেঞ্জে সংরক্ষণ—সব দিক দিয়েই বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। চারা তৈরির কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে ঝাড়গ্রামের আমলাচটিতে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার পর সাফল্য মিললে ভেষজ উদ্ভিদের জগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলেই সকলের আশা।
ভেষজ চাষে উৎসাহ
পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া—তিনটি জেলার ৩০০ হেক্টর জমিতে ওষধি গাছ লাগাবে বন দফতর।
জঙ্গল এলাকার স্ব-সহায়ক দল, বন সুরক্ষা কমিটি বা স্থানীয় মানুষও ভেষজ চাষে সাহায্য পাবেন।
ব্যক্তিগত ভাবে চাষ করলে প্রথমবার বীজ থেকে প্রযুক্তি সবই দেবে বন দফতর।
আগামি দু’বছরে এই প্রকল্পে ৯ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা পেয়েছে বন দফতরের সিলভিকালচার শাখা (দক্ষিণবঙ্গ)।
কী বলছেন ডিএফও
প্রথমবার চারা থেকে প্রযুক্তি সব আমরা দেব। লাভ পুরোটাই চাষিদের। পরের বার সেই লাভ থেকে নিজেদেরই চাষ করতে হবে চাষিদের। তবে বাজারের বিষয়টি দেখভাল করবে বন দফতরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy