ভাঙছে জানি, তবু মনের মধ্যে তোলপাড়।
১৭৭৭ সালে মেদিনীপুর-জলেশ্বর প্রশাসনিক জেলা রূপে আত্মপ্রকাশ। নতুন জেলার কালেক্টর হলেন জন পিয়ার্স। ১৭৮৩ সালে মেদিনীপুর জেলা ঘোষণা হল। মেদিনীপুর হল জেলাশহর। জন পিয়ার্স-ই থাকলেন কালেক্টর। স্বাধীনতার সাড়ে পাঁচ দশক পরে সেই জেলা যখন প্রশাসনিক কারণে উন্নয়নের জন্য দু’ভাগ হয়ে গেল ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি, তখন মনে কেমন যেন বেজেছিল বিষণ্ণতার সুর। তবু দুই জেলার মানুষ মেদিনীপুরের ছায়ায় থেকে যে অখণ্ড মেদিনীপুর চেতনার ছবি এঁকেছিল, আজও তার রেশ কাটেনি। তার ১৫ বছর পরে আবার পশ্চিম মেদিনীপুর প্রশাসনিক কারণেই উন্নয়নের জন্য ভাঙতে চলেছে। মনে সেই বিষণ্ণতাই।
এক দিকে সুগভীর বন, সিংভূম পর্বতমালার অবশেষ এবং শাল মহুয়ার ছায়ায় ঢাকা ল্যাটেরাইট শিলার তরঙ্গায়িত পুরাভূমি। অন্য দিকে পূর্ব-মহাসাগরের বেলাভূমি, মাঝখানে শস্য-শ্যামল চাষের খেত, উর্বর সমতট। পশ্চিমের মাটিতে আঁকা আছে প্রায় দশ হাজার বছরেরও আগের আদিমানবের চিহ্ন। পুর্বের সাগর সৈকতে পড়ে আছে হিউয়েন-সাঙ, ইৎ সিঙ, প্রিয়দর্শী অশোকের সঙ্গে তাম্রলিপ্ত বাণিজ্য বন্দরের স্মৃতি-সত্তা। মাটিতে কান পাতলেই শোনা যায় রাজা মান সিংহ, টোডরমল, শাহজাহান, ঔরঙ্গজেব, শা-সুজা, আলিবর্দি খাঁ, সিরাজদৌল্লার পদধ্বনি। স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবী যোদ্ধাদের আঁতুড়ঘর এই মাটিতেই। অখণ্ড মেদিনীপুরের মাটিতে আসন পেতে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী চণ্ডীমঙ্গল কাব্য লিখেছিলেন। কাশীরাম দাস লিখেছিলেন মহাভারত। এখানেই রামেশ্বর ভট্টাচার্য শিবায়ন কাব্য এবং গোপীজনবল্লভ দাস রসিকমঙ্গল কাব্য লিখে অমর হয়ে আছেন। বাংলা গদ্য সাহিত্যের দুই দিকপাল মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই জেলারই সন্তান।
১৯২২ সালে মেদিনীপুর জেলার সদর মহকুমার ঝাড়গ্রাম, গোপীবল্লভপুর এবং বিনপুর থানাকে নিয়ে হল ঝাড়গ্রাম মহকুমা। ১৯৩১ সালে যখন এই ঝাড়গ্রামকে মেদিনীপুর জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা হয়েছিল তখন বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে ঝাড়গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ‘মেদিনীপুর বিচ্ছেদ-বিরোধী কমিটি’ গড়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। স্যামুয়েল-ওডোনেল কমিটির রিপোর্টে ঝাড়গ্রামবাসীর সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমত প্রাধান্য পেয়েছিল।
এ বার পটভূমি সম্পূর্ণ পৃথক। উন্নয়নের স্বার্থে এই বিভাজন। প্রয়োজন, তাই ভাঙুক। উন্নয়নের নতুন নাম হোক ঝাড়গ্রাম। কিন্তু নতুন জেলার নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকুক মেদিনীপুর নামের আবেগ।
লেখক জঙ্গলমহলের ভূমিপুত্র। অবসরপ্রাপ্ত জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক। জঙ্গলমহলের লোকসংস্কৃতি, ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব বিষয়ের গবেষক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy