কামরায় এভাবেই সাঁটানো থাকে পোস্টার (চিহ্নিত)। নিজস্ব চিত্র।
ট্রেনের কামরায় সদ্য বাংলা পড়তে শেখা পাঁচ বছরের আবেশ জোরে জোরেই পড়ছিল খবরের কাগজের মোটা মোটা হরফের হেডলাইন। পাশে চোখ বন্ধ করে শুনছিলেন তার মা।
কিন্তু আবেশের চোখ খবরের কাগজ ছেড়ে বার বার সরে যাচ্ছিল কামরার দেওয়ালে ঝোলানো চেনটার দিকে। তার পাশেই সাঁটা কাগজে মোটা মোটা অক্ষরে লেখা, ‘গুপ্তরোগ’, ‘গর্ভপাত’, ‘যৌন সমস্যা’...। সেটাও পড়া শুরু করেছিল একরত্তি ছেলেটা। চোখ খুলে ফেলেন আবেশের মা। কামরাভর্তি যাত্রীদের সামনে লজ্জায় তাঁর মুখ লাল। বড় করে চোখ পাকিয়েও থামাতে পারছিলেন না ছেলেকে। আবেশ বুঝতে পারছিল না, তার বাংলা পড়ার ইচ্ছেটা কেন থামিয়ে দিতে চাইছেন মা!
দিন কয়েক আগের এই ঘটনার সাক্ষী দক্ষিণ-পূর্ব রেলের হাওড়া-মেদিনীপুর শাখার একটি লোকাল ট্রেনের অনেক যাত্রীই। তাঁরাই বলছেন, সে দিনের ঘটনাটি কোনও বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়। এই শাখার বহু লোকালের কামরাই এখন ‘গুপ্তরোগ’ এবং ‘যৌন রোগ’ নিরাময়ের বিজ্ঞাপনে ঢেকেছে। যা এক অর্থে দৃশ্য দূষণের সামিল। বাস্তবিকই, ওই শাখার যে কোনও ট্রেনে একবার চড়লেই কামরায় ওই জাতীয় বিজ্ঞাপন চোখে পড়বেই। যাত্রীদের অভিযোগ, দেশ জুড়ে স্বচ্ছ ভারত গড়ার ডাক দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অথচ, কিছুতেই কেন্দ্র সরকারের অধীনস্থ রেলের এই ‘রোগ’ সারছে না!
কী বলছেন রেলকর্তারা?
দক্ষিণ-পুর্ব রেল সূত্রে জানানো হয়েছে, ট্রেনের কামরায় এই ধরনের আপত্তিকর বিজ্ঞাপন সাঁটানো দণ্ডনীয় অপরাধ। হাওড়া-মেদিনীপুর শাখায় সারাদিনে প্রায় ১০০ জোড়া ট্রেন চলে। লক্ষাধিক যাত্রী যাতায়াত করেন। এই পরিমাণ মানুষের কাছে প্রায় বিনা খরচে প্রচারের লোভেই এই অপরাধ করে কিছু লোক। ধরা পড়লে তাদের শাস্তির ব্যবস্থাও হয়। ওই শাখার মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সঞ্জয় ঘোষ বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে আমরা কিছুটা অসহায়। তাই কিছুদিন অন্তর কারশেডে ট্রেনগুলিকে ধুয়ে পরিষ্কার করে দিই।’’
কিন্তু নিত্যযাত্রীদের দাবি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ট্রেনের কামরার দেওয়াল দেখা যায় কালেভদ্রে। ওই শাখার প্রায় সমস্ত লোকাল ট্রেনের কামরায় ওই বিজ্ঞাপন অস্বস্তিতে ফেলে দেয় মহিলা যাত্রী থেকে স্কুল পড়ুয়া—সকলকেই। মহিলা বাচিক শিল্পী সঞ্চিতা কবিরাজ জানান, সপ্তাহে তিনদিন তিনি লোকালে তমলুক থেকে কলকাতা যান। মাঝেমধ্যেই সাধারণ কামরায় ওঠেন। তিনি বলেন, ‘‘পুরুষ যাত্রীদের মাঝে বসার জায়গা পেলেও মাথা তুলে তাকাতে পারি না দেওয়ালে সাঁটানো আপত্তিকর বিজ্ঞাপনের জন্য। ট্রেনের কামরা কি কখনও স্বচ্ছ হবে না!’’
যাঁরা এই সব বিজ্ঞাপন দেন, তাঁদের মধ্যে এক হাতুড়ে চিকিৎসক মেচেদা স্টেশন সংলগ্ন একটি হোটেলের ঘরে মাসে দু’দিন রোগী দেখেন। তিনি জানান, সারা মাসে যা রোগী দেখেন তার ৮০% গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা। গোপন রোগের শিকার। তাঁরা শহরের বড় ডাক্তার এড়িয়ে চলেন। তিনি মেনে নিয়েছেন, ‘‘এই ব্যবসার বিজ্ঞাপন খবরের কাগজে দিতে অনেক খরচ। সেই তুলনায় দুই জেলার বিশাল সংখ্যক রোগীর কাছে সহজে এবং প্রায় বিনা খরচে পৌঁছে যাওয়ার রাস্তা হল লোকাল ট্রেনের কামরা।’’
যাত্রীরা ধরেই নিয়েছেন, এই ‘দূষণ’ থেকে তাঁদের নিস্তার নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy