জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের উদ্যোগে জলাধার তৈরি হয়ে গিয়েছিল দাদনপাত্রবাড়ে। আদালতের নির্দেশের পর অবশ্য থমকে কাজ। ছবি: সোহম গুহ।
সমস্যাটা অনেক দিনের। কিন্তু হুঁশ ছিল না রাজ্য সরকারের। তবে এতদিনে সরকার স্বীকার করেছে, রাজ্যের উপকূলীয় এলাকার মানচিত্র তৈরি করতেই পারেনি পরিবেশ দফতর। চিহ্নিত করা যায়নি উপকূলীয় বিধিভুক্ত এলাকাও (কোস্টাল রেগুলেটরি জোন বা সিআরজে়ড)।
তবে সে সবের তোয়াক্কা না করেই ২০১৪ সাল থেকে মন্দারমণির দাদনপাত্রবাড়ে সজলধারা প্রকল্পে গভীর নলকূপ বসানোর কাজ শুরু করেছিল রাজ্যের জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর। আশি শতাংশ কাজও শেষ হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এ নিয়ে মামলা হওয়ায় জাতীয় পরিবেশ আদালত ওই এলাকায় গভীর নলকূপ বসানোর উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। মন্দারমণি উপকূল এলাকায় সিআরজেড ম্যাপ তৈরি না হওয়া পযর্ন্ত গ্রিন ট্রাইবুনালের এই নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে বলেও মামলাকারীদের আইনজীবী রাহুল গঙ্গোপাধ্যায় জানান।
মন্দারমণি নিয়ে পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। তাঁদের মতে, গোটা বিশ্বের আবহাওয়া-জলবায়ুতে যে ভাবে বদল আসছে, তাতে সব থেকে বিপদে পড়বে উপকূলীয় এলাকাগুলি। রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ইন্টার-গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-এর সর্বশেষ রিপোর্টেও তেমনটা বলা হয়েছে। অথচ, এ রাজ্যের উপকূলীয় পরিবেশ নিয়ে রাজ্যের গা-ছাড়া মনোভাবই বারবার ফুটে উঠেছে। ‘ইন্টিগ্রেটেড কোস্টাল জোন ম্যানেজমেন্ট’ প্রকল্প নিয়ে বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্টেও তেমনই ইঙ্গিত দিয়েছে। পরিবেশবিদের একাংশের বক্তব্য, মন্দারমণিতে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে পরিবেশ ধ্বংস করে। নষ্ট হয়েছে সমুদ্রতটের আদি বাসিন্দা লাল কাঁকড়া। ফলে কোনও বড় মাপের ঘূর্ণিঝড় বয়ে এলে ওই এলাকা তছনছ হয়ে যেতে পারে। রাজ্য সরকারের প্রাক্তন উপকূল বিশেষজ্ঞ সোমনাথ ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘উপকূলীয় বিধিভুক্ত এলাকায় গভীর নলকূপ নিয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পুরনো মানচিত্র অনুযায়ী মন্দারমণি তো উপকূলীয় এলাকাভুক্ত এলাকার প্রথম সারিতে (সিআরজেড-১) পড়ে!’’
এ তো গেল বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞদের কথা। কিন্তু এ নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন স্থানীয় মৎস্যজীবীরাও। কী বলছেন তাঁরা?
দাদনপাত্রবাড় মৎস্যখটির মৎস্যজীবীদের তরফে সহ-সম্পাদক শ্রীকান্ত দাস বলছেন, এই গভীর নলকূপ বসানো হলে স্থানীয় মৎস্যজীবীদের মাছ শুকনো করার জায়গা থাকবে না। গভীর নলকূপ দু’টি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন যন্ত্রের সাহায্যে সৈকত এলাকার মাটির নীচের সমস্ত জল টেনে নেবে। ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য সাধারণ নলকূপে জল পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। পানীয় জলের সঙ্কট তৈরি হবে। দক্ষিণবঙ্গে মৎস্যজীবী ফোরামের সহ-সভাপতি দেবাশিস শ্যামল বলেন, “গভীর নলকূপ বসানো নিয়ে দাদনপাত্রবাড় মৎস্যখটি ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করা হয়। তা এখনও বিচারাধীন।” পরে বিষয়টি নিয়ে জাতীয় পরিবেশ আদালতের দ্বারস্থ হয় পরিবেশ নিয়ে কাজ কার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সেই মামলার প্রেক্ষিতেই এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
ঠিক এমনই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে জাতীয় পরিবেশ আদালতে বিচারাধীন থাকা মন্দারমণি সংক্রান্ত আর একটি মামলাতেও। সেই মামলাতেও মন্দারমণি এলাকায় নির্মাণে ও নকশা অনুমোদনে স্থগিতাদেশ দিয়েছে পরিবেশ আদালত। মামলাকারীর আইনজীবী সোমনাথ রায়চৌধুরী বলছেন, ওই এলাকায় বালিয়াড়ি, সবুজ ধ্বংস করা হয়েছে। সাগরতটে গাড়ি চলার ফলে লাল কাঁকড়া নির্বংশ হয়ে গিয়েছে। গাড়ি চলা আটকাতে রাজ্য পুলিশচৌকি বসানোর কথা বললেও বাস্তবে গাড়ি চলা বন্ধ হয়নি।
গভীর নলকূপের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির প্রেক্ষিতে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের দিঘার সহকারী ইঞ্জিনিয়ার সুকুমার বর্মনের কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি। বুধবার দুপুরে তাঁর অফিসে বারবার টেলিফোন করা হলেও কেউ ফোন ধরেননি। মোবাইলও বন্ধ মিলেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি উপকূলীয় এলাকা নিয়ে বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও রাজ্য কেন সিআরজেড মানচিত্র তৈরি করতে পারল না?
রাজ্য পরিবেশ দফতরের এক শীর্ষ কর্তা জানান, চেন্নাইয়ের ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর সাসটেনেবল কোস্টাল জোন ম্যানেজমেন্ট’ সংস্থাকে গোটা দেশের হাই-টাইড লাইন (জোয়ারের জল যত দূর পর্যন্ত যায়) চিহ্নিত করার দায়িত্ব দিয়েছিল কেন্দ্র। সেই তথ্য না পাওয়ায় উপকূলীয় এলাকার জন্য মানচিত্র এবং তার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করা যায়নি। এ ব্যাপারে ফের চিঠি চালাচালিও শুরু হয়েছে বলে পরিবেশ দফতর সূত্রের দাবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy