Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

হাতে ভাজা মুড়ির কদর জেলার বাইরেও

চপ, বেগুনির সঙ্গে মুচমুচে মুড়ি— আম বাঙালির খাদ্য তালিকায় অন্যতম অঙ্গ দীর্ঘদিন। আর দক্ষিণবঙ্গের অধিকাংশ বাসিন্দার সকালের চা বা খাবারের তালিকায় মুড়ির স্থান এখনও প্রথম সারিতে।

চলছে মুড়ি বিক্রি। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।

চলছে মুড়ি বিক্রি। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।

আনন্দ মণ্ডল
নন্দকুমার শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:৪৮
Share: Save:

চপ, বেগুনির সঙ্গে মুচমুচে মুড়ি— আম বাঙালির খাদ্য তালিকায় অন্যতম অঙ্গ দীর্ঘদিন। আর দক্ষিণবঙ্গের অধিকাংশ বাসিন্দার সকালের চা বা খাবারের তালিকায় মুড়ির স্থান এখনও প্রথম সারিতে। খাদ্য তালিকায় এমন গুরুত্বপূর্ণ মুড়ি বিক্রির একটা আস্ত বাজার বসে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমারে। সপ্তাহে দু’দিন সোমবার ও শুক্রবার সকালে হাট বসে নন্দকুমার বাজারে। আর নন্দকুমারের হাটের মধ্যে আলাদাভাবে শুধু মুড়ির বাজার বসে আসছে প্রায় ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। প্রায় দু’শোর বেশি মুড়ি ব্যবসায়ী আসেন নন্দকুমারের এই মুড়ির বাজারে। বিভিন্ন ধরনের হাতে ভাজা মুড়ির পসরা। তাই নন্দকুমারের এই মুড়ির বাজারের খ্যাতি ছড়িয়ে রয়েছে সারা জেলা জুড়েই।

অন্য দিকে এই মুড়ির বাজারের উপর নির্ভর করেই চলে কয়েক হাজার মানুষের জীবিকা। কিন্তু হাতে ভাজা মুড়ি ব্যবসায়ীদের জীবিকাতে ছায়া ফেলেছে আধুনিক মেশিনে ভাজামুড়ির রমরমা। ফলে অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছেন নন্দকুমারের মুড়ি ব্যবসায়ীরা। অল্প সময়ে বেশি মুড়ি ভেজে ফেললে বাজারে তার দামও কমে। বাড়ে বিক্রি মুড়ির বাজারের ব্যবসায়ীদের সিংহভাগই হলদি নদীর ওপারের চণ্ডীপুরের পড়িয়ারচক, মাজনাবেড়িয়া, বিরামপুর এলাকার বাসিন্দা। কেউ কেউ অবশ্য নন্দীগ্রামের। সোম-শুক্রবার ভোরবেলা বাড়ি থেকে মেশিনভ্যানে বড় বড় বস্তা বোঝাই মুড়ি চাপিয়ে নিয়ে হাজির হন হলদিয়া-মেচেদা রাজ্য সড়কের ধারে নন্দকুমারের মুড়ির বাজারে।

চণ্ডীপুরের মুড়ি ব্যবসায়ীরা জানান, নন্দকুমারের মুড়ি বাজার গত ৪০বছর ধরে বসছে। এখানকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল হাতে ভাজা বিভিন্ন ধরনের মুড়ি বিক্রি হয়। তমলুক, মহিষাদল, হলদিয়া-সহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় মুড়ি কিনে নিয়ে যান পাইকারী ব্যবসায়ীরা। আবার এখানে সাধারণের জন্য খুচরো বিক্রির ব্যবস্থাও আছে। এখনও প্রতি হাটে ৩০ থেকে ৪০ কুইন্টাল মুড়ি বেচা-কেনা চলে।

গত ১০ বছর ধরে নন্দকুমার মুড়ি বাজারে আসেন চণ্ডীপুরের বিরামপুর গ্রামের মুড়ি ব্যবসায়ী বুদ্ধদেব ভৌমিক। তাঁর অভিজ্ঞতায়, ‘‘তিন পুরুষের মুড়ির ব্যবসা। মুড়ির ভাজাই আমাদের প্রধান জীবিকা। বাড়ির মহিলা, পুরুষ সকলেই মুড়ি ভাজার কাজে যুক্ত।’’

মুড়ির জন্য কাঁকর, সুপার শ্যামলী, মতি, বর্ষা জাতের ধান দরকার। এইসব ধানের বেশির ভাগটাই আসে ওড়িশা থেকে। প্রথমে বিশেষ পদ্ধতিতে ধান থেকে চাল তৈরি করে মুড়ি ভাজার উপযোগী করে তোলা হয়। এরপর উনুনে কড়াই বসিয়ে হাতের কায়দায় চাল নেড়ে মুড়ি ভাজা হয়। ধানের জাত অনুযায়ী মুড়িরও নামকরণ হয় কাঁকর, মতি, শ্যামলী, বর্ষা, হাজার১০ প্রভৃতি। আর ধানের দাম, মুড়ির গুণগত মান অনুযায়ী স্থির হয় মুড়ির দাম। সাধারণত কাঁকর ধানের মুড়ির দাম হয় সবচেয়ে বেশি। এরপর মতি, শ্যামলী মুড়ির চাহিদা।

নন্দকুমারে পাইকারি মুড়ির বাজার শুরু হয় সকাল ৬ টা থেকে, চলে সকাল ৯ টা পর্যন্ত। এরপর শুরু খুচরো মুড়ির বাজার। তা চলে বেলা প্রায় ১১ টা পর্যন্ত। কিন্তু সময়ের সঙ্গেই বদলেছে মুড়ি ব্যবসায়ীদের জীবিকার ধরন। কয়েকবছর আগেও হাতে ভাজা মুড়ির যে কদর ছিল তা এখন নেই। বরং মেশিনে ভাজা মুড়ির বাজার বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন শুধুমাত্র কম সময়ে বেশি মুড়ি ভেজে ফেলার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন এক শ্রেণির ব্যবসায়ী।

এখন প্রায় প্রতিটি গ্রামেই তৈরি হয়েছে মুড়ি মিল। মুড়ি ভাজার মত কাজে যন্ত্র প্রবেশের ফলে সঙ্কটে পড়েছেন মুড়ি ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ। চণ্ডীপুর ব্লকের মাজনাবেড়িয়া গ্রামের ব্যবসায়ী শিবশঙ্কর মণ্ডল আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘‘গত পাঁচ-ছ’বছরে মেশিনে ভাজা মুড়ি বাজার দখল করছে। আমাদের মুড়ির চাহিদা কমেছে। আর কতদিন এই ব্যবসায় যুক্ত থাকতে পারব তা জানি না।’’

নন্দকুমার মুড়ি বাজারের স্থান পরিবর্তন হয়েছে। আর তা নিয়েও চিন্তিত ব্যবসায়ীরা। এখন রাজ্য সড়কের ধারে খোলা আকাশের নীচে মুড়ির বস্তা রেখে বেচা-কেনা চলে। আগেকার হাট থেকে অনেকটাই দূরে। তবু ঐতিহ্য রয়েছে। নন্দকুমার বাজার মুড়ি ব্যবসায়ী কমিটির সম্পাদক অশোক জানা জানান, নরঘাটের কাছে হলদি নদীর উপর মাতঙ্গিনী সেতু চালু হওয়ার আগে চণ্ডীপুরের দিক থেকে নৌকায় করে মুড়ি আসত। এখন পথ অনেক সহজ হয়েছে। কিন্তু বছর পাঁচেক হল সেখান হাটের পুরনো এলাকায় নতুন দোকান ঘর তৈরি হয়েছে। তাই কয়েকশো মিটার দূরে রাজ্য সড়কের পাশে সরে এসেছে মুড়ির বাজার। অশোকবাবুর গলাতেও ঝরে পড়ে সেই আশঙ্কা, ‘‘আগে প্রায় আড়াইশোর বেশি মুড়ি ব্যবসায়ী আসতেন। এখন তা কমেছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। বাসিন্দাদের সহায়তায় আমরা এখানে ব্যবসা করে যাচ্ছি, জানি না কত দিন পারব।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE