উদ্ধারের পর মৎস্যজীবীরা। —নিজস্ব চিত্র।
মাঝ সমুদ্রে ১৬ দিন ধরে উদ্দেশ্যহীন ভেসে চলেছে একটি ট্রলার। তাতে সওয়ার ছয় মৎস্যজীবী। কূলের দেখা তো নেই, উল্টে বেঁচে থাকার রসদ খাবার আর পানীয় জলও শেষ। ভরসা বলতে কাঁচা মাছ আর ট্রলারে থাকা বরফ ও সমুদ্রের জলের মিশেল।
এ যেন ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’-র নায়ক সানতিয়াগোর জীবনকথা। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সেই উপন্যাসের মতোই অভিজ্ঞতা হল মাছ শিকারে গিয়ে নিখোঁজ অন্ধ্রপ্রদেশের ছয় মৎস্যজীবীর। দীর্ঘ ১৬ দিন নিখোঁজ থাকার পর অবশ্য ছ’জনকেই নিরাপদে উদ্ধার করেছে উপকূলরক্ষী বাহিনী।
শুক্রবার সকালে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগর থেকে প্রায় ১৪৫ নটিক্যাল মাইল দূরে এবং বিশাখাপত্তনম থেকে প্রায় ৩০০ নটিক্যাল মাইল দূর থেকে তাঁদের উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয় হলদিয়ায়। তাঁদের শনিবারই অন্ধ্রপ্রদেশের মৎস্য দফতরের আধিকারিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় বলে জানান উপকূলরক্ষী বাহিনীর ডিআইজি সনাতন জেনা। তিনি জানান, ছয় ম়ৎস্যজীবীর মধ্যে এস নাগুর ও টি নাগারাজুর বাড়ি অন্ধ্রপ্রদেশের মছলিপত্তনমে। কে ভেঙ্কটেশ, কে জালাইয়া, কে জালাইয়া এবং কে চিট্টিবাবুর বাড়ি অন্ধ্রপ্রদেশের নেল্লোর জেলায়। অন্ধ্রপ্রদেশের এই বাসিন্দারা কথা বলছিলেন তেলুগু ভাষায়। তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা জানতে সাহায্য নিতে হয়েছিল এক দোভাষীর।
কীভাবে কেটেছে মাঝ সমুদ্রের দিনগুলো?
জানা গিয়েছে, গত ১৫ জুন অন্ধ্রপ্রদেশের মছলিপত্তনম থেকে ওই ছয় মৎস্যজীবী সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। কিন্তু দিন তিনেক পর মাঝ সমুদ্রে তাঁদের ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূলের মৎস্যজীবীরা যোগাযোগ করতে পারছিলেন না ওই মৎস্যজীবীদের সঙ্গে। উদ্ধারকারী জাহাজে দাঁড়িয়ে কে ভেঙ্কটেশ, কে চিট্টিবাবু জানান, ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাওয়ার পর থেকে মাছ সমুদ্রেই ভাসছিলেন তাঁরা। বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগও। দিন কয়েক পর বৃষ্টি হওয়ায় জল উঠতে থাকে ট্রলারে। তখন তাঁরা পালা করে জল ছেঁকে সমুদ্রে ফেলেছেন। এমনকী প্রথম তিনদিন তাঁরা যে মাছ ধরেছিলেন, তারা সেগুলো সেই সময় সমুদ্রে ফেলে দিয়েছিলেন।
তারপরের অভিজ্ঞতা আরও ভয়ঙ্কর। এস নাগুরের কথায়, ‘‘দিন ছয়েকের মধ্যে আমাদের খাবার শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই সমুদ্রের ছোট ছোট মাছ ধরে স্টোভে রান্না করে খেয়েছি। সপ্তাহ খানেক আগে কেরোসিন ফুরিয়ে গিয়েছিল। শেষ হয়ে গিয়েছিল পানীয় জলও। শুধু কাঁচা মাছ ধরে খেয়েও দিন কাটিয়েছি। আর ট্রলারে থাকা বরফ ও সমুদ্রের জল মিশিয়ে পানীয় জল হিসাবে খেয়েছি। ৪০ বছর ধরে মাছ ধরছি। কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম।’’ দোভাষীর মাধ্যমে কে জালাইয়া বলেন, ‘‘ভাবতেই পারিনি বেঁচে ফিরব। উপকূলরক্ষী বাহিনী আমাদের কাছে ভগবান। এ দিনই স্ত্রী তারিতম্যকে ফোন করে ছেলে মেয়ের খোঁজ নিয়েছি।’’
আর হলদিয়া উপকূল রক্ষী বাহিনীর তরফ থেকে জানা গিয়েছে, গত ২০ জুন চেন্নাইয়ের উপকূলরক্ষী বাহিনীর মাধ্যমে খবর পৌঁছায় হলদিয়া উপকূলরক্ষী বাহিনীর কাছে। তার পর থেকে উপকূলরক্ষী বাহিনীর জাহাজ ও দুটি হেলিকপ্টার বঙ্গোপসাগরে তল্লাশি শুরু করে। গত ২রা জুলাই দুপুরে একটি হেলিকপ্টার ওই ট্রলারের খোঁজ পায়। উপকূলরক্ষী বাহিনীর ডিআইজি সনাতন জেনার কথায়, ‘‘শুক্রবার সকালে রাজকিরণ নামে আমাদের একটি জাহাজ গিয়ে মাঝ সমুদ্রে ট্রলার থেকে ওই ৬ জনকে উদ্ধার করেছে। ৬ জনের মধ্যে একজন অসুস্থ্ ছিল। তাদের জাহাজে তুলে চিকিৎসা করা হয়েছে। তবে সকলেই এখন সুস্থ রয়েছেন।’’ মৎস্যজীবীদের উদ্ধারের ঘটনায় উদ্ধারকারী জাহাজের কমান্ডার এল জউ-কে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন কাঁথির ফিসারি এক্সটেনশন অফিসার অরুণকুমার জানা ও দিঘা ফিসারম্যান অ্যাণ্ড ফিস ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার সুধাংশু জানা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy