রকির স্মৃতিতে ঝাড়গ্রাম শহরে মোমবাতি মিছিল। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
সবুজ শালগাছের আঁচল পরানো কালো পিচের রাস্তা। অরণ্যশহরের সেই রাস্তা ধরে মোটরবাইক ছুটিয়ে চলে যেত ছেলেটা। মুখের সারল্যভরা হাসিটা চিনত সবাই। পঁচিশ বছরের তরতাজা সেই রকি হারিয়ে গিয়েছিলেন গত মাসের পঁচিশ তারিখে।
খবরটা বন্ধুরা প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি। আশা ছিল, ঠিক ফিরে আসবে রকি। দিন কয়েক আগে পর পর দু’বার অপহরণকারীরা রকির সঙ্গে পরিজনদের মোবাইলে কথা বলানোয় প্রত্যাশার পারদটাও দপ করে চড়ে গিয়েছিল। আড্ডায় রকির বন্ধুরা বলাবলি করছিলেন, “রকির মতো ‘জিন্দাদিল’কে কত দিন কিডন্যাপ করে রাখবে? ফিরে এলে ওর কাছে টানটান থ্রিলারের গল্পটা শুনতে হবে!”
বাড়িতে ঠাকুর ঘরে মাথা ঠুকে ছেলের ফেরায় অপেক্ষায় চোখের জল মুছেছিলেন সত্যভামা অগ্রবালও। অরণ্যশহরে ঝোড়ো হাওয়ার মতো রটে গিয়েছিল, রকি ভাল আছে। বৃহস্পতিবার তিন অভিযুক্তের গ্রেফতারের খবরে সবাই নিশ্চিত হয়ে যান, রকি ফিরছেনই। অপহরণকারীদের ডেরা থেকে রকি ফিরে এসে বন্ধুদের হয়তো বলবেন, “জানুয়ারিতে তো সিকিম গিয়েছিলাম, চল এবার গরমে সিমলা ঘুরে আসি।”
মুহূর্তেই সব প্রত্যাশা খানখান হয়ে যায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। অরণ্যশহর জেনে যায়, রকি আর নেই। শুক্রবার সন্ধ্যায় রকির স্মৃতিকে বুকে নিয়ে মোমের শিখায় তাঁকে স্মরণ করল ঝাড়গ্রাম। অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মোমবাতি নিয়ে দীর্ঘ পদযাত্রা করলেন শহরবাসী। সামিল হন দলমত নির্বিশেষে সব স্তরের মানুষ।
চোখ বুজলেই পরিজনেরা দেখতে পাচ্ছেন চেনা সেই ছবিগুলো। বাইকে হাসিমুখের ছিপছিপে চেহারাটা চলে যাচ্ছে হুউশ করে রকির বন্ধুবান্ধবদের কাছে ছবিটা ছিল চেনা। এক বন্ধু জানাচ্ছেন, “দেড়-দু’বছর অন্তর বাইক বদলাতেন রকি।” বলরামডিহির বাড়িটা থেকে আর রকি বাইক হাঁকিয়ে বেরোবো না। বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় মেতে ওঠার মঝেই পথচলতি শিশুর হাতে আইসক্রিম ধরিয়ে কেউ বলবে না, ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার।’ ছা-পোষা খদ্দেরকে অবলীলায় রড-সিমেন্ট দিয়ে কেউ বলবে না, ‘আঙ্কেল, আপনি আগে বাড়ি বানান। পরে কিস্তিতে টাকা মেটাবেন।’ হ্যাঁ, এমনই ছিলেন সৌরভ অগ্রবাল। রকি নামেই যাঁকে চিনত সকলে।
বাবার ইমারতি ব্যবসাকে বাড়িয়ে তুলেছিলেন রকি। দরদি রকির স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সকলকে। রকির এক বন্ধুর বিয়ে ছিল গত মাসের ২২ তারিখ। কথা ছিল বরযাত্রী যাবেন রকি। বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে সাজিয়ে গুছিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়ে হঠাৎ রকি গেলেন না। এমনই ‘মুডি’ ছিলেন তিনি।
রকির স্কুল ঝাড়গ্রাম কুমুদকুমারী ইনস্টিটিউশনের প্রধানশিক্ষক অনুপ দে বলেন, “আমার শিক্ষক জীবনে এত বিনয়ী ছাত্র খুব কম দেখেছি। একবার স্কুলের সরস্বতী পুজোর দায়িত্ব পেয়ে নিজের পকেট থেকে বাড়তি খরচ জুগিয়েছিল। এমনই ব্যতিক্রমী ছিল রকি।” রকির এক শিক্ষক-বন্ধু বলছেন, “নভেম্বরে বাড়ি তৈরির জন্য রকির থেকে প্রায় এক লাখের ইমারতি সরঞ্জাম কিনেছিলাম। মালপত্র দিয়ে টাকাই নেয় নি ও। টাকা দিতে গেলে বলত, তুই কী আমার টাকা নিয়ে নিবি? শেষে জোর করেই ডিসেম্বরে মাসে ওর হাতে টাকাটা ধরিয়ে দিয়েছিলাম।”
রকির হাসিটা ভুলতে পারছেন না পরিজনেরা। ফেসবুকে রকির প্রোফাইলে আছড়ে পড়ছে বেদনা। বন্ধুরা লিখছেন, যেখানেই থাকিস, ভাল থাকিস রকি...।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy