কারও বাবা জমিজমা বিক্রি করে পাঠিয়েছেন, কারও মা বিয়ের গয়না বন্ধক রেখেছেন, কারও পরিবার আবার মোটা সুদে ঋণ নিয়েছেন। সকলেই চেয়েছেন সন্তানের স্বপ্ন সফল হোক। দেশে সুযোগ না পেলেও বিদেশ থেকে ডাক্তারির ডিগ্রি নিয়ে আসুক।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ওঁরা যুদ্ধ দেখেছেন। লেখাপড়ার দেশে যুদ্ধ লেগে যেতে ফিরে এসেছে মাতৃভূমিতে। তবে ওঁরা ফিরে যেতে চান। ওঁরা জানেন, এক দিন যুদ্ধ থেমে যাবে। শান্ত হবে ইউক্রেন। যেখানে জমা রাখা আছে ওঁদের চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন। ওঁদের একার নয়, পরিবার, পরিজনদেরও স্বপ্ন। যে স্বপ্নের মধ্যে মিশে আছে অনেক অনেক অর্থও।
সিউড়ির শাহরুখ থেকে সোনারপুরের শ্রীমা, ইউক্রেন থেকে প্রাণ হাতে করে ফেরা বাংলার পড়ুয়ারা বলছেন, ফের যাবেন। আসলে বলছেন, ‘যেতে তো হবেই।’ কারও বাবা জমিজমা বিক্রি করে পাঠিয়েছেন, কারও মা বিয়ের গয়না বন্ধক রেখেছেন, কারও পরিবার আবার মোটা সুদে ঋণ নিয়েছেন। সকলেই চেয়েছেন সন্তানের স্বপ্ন সফল হোক। দেশে সুযোগ না পেলেও বিদেশ থেকে ডাক্তারির ডিগ্রি নিয়ে আসুক। কে জানত এমন করে যুদ্ধ আছড়ে পড়বে! ক’দিন আগেও যাঁরা ভাবছিলেন ছেলেমেয়েরা ঠিকঠাক ফিরে আসুক, তাঁরাই এখন ভাবছেন আবার পাঠাতে হবে।
বীরভূমের সিউড়ি শহরের সাজানো পল্লির বাসিন্দা শাহরুখ সুলতান আহমেদ দেশে ফেরার পথে। ভারত সরকারের বিমানের অপেক্ষায় থাকা শাহরুখের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে তাঁর বাবা আফতাবউদ্দিন বলেন, ‘‘যেতে তো হবেই। অনেক টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষাতেও পাশ করে গিয়েছে। এখন শুধু বাকি ইউক্রেন সরকারের নেওয়া শেষ পরীক্ষাটা। সেটা হওয়ার কথা আগামী ২৪ মে। যুদ্ধ থেমে গেলে নিশ্চয়ই কিছু একটা হবে।’’ সরকারি চাকরি করতেন আফতাবউদ্দিন। তাঁর বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। বাবার সঞ্চয় আর নিজের সঞ্চয় মিলিয়েও শাহরুখের ইউক্রেনে পড়ার টাকা জোগাড় করতে পারেননি আফতাবউদ্দিন। আত্মীয়-স্বজনরাও টাকা দিয়েছেন। আসলে পরিজনদেরও স্বপ্ন, তাঁদের শাহরুখ এক দিন ডাক্তার হবেন। তবে ভরসা হারাচ্ছেন না আফতাবউদ্দিন। বললেন, ‘‘যুদ্ধের জন্য তো আর পড়ুয়ারা দায়ী নয়। আশা করি অনলাইনে পরীক্ষার ব্যবস্থা হবে। অথবা যুদ্ধ থামলে ওখানে গিয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হবে।’’ অনলাইনে পরীক্ষা হলে ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে ডিগ্রি মিলতে পারে বলেও আশা করছে শাহরুখের পরিবার। কিন্তু জানা নেই, যুদ্ধ বিধ্বস্ত কিভ শহরের মেডিক্যাল কলেজ ঠিক কী করবে!
প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলে মেয়েকে ইউক্রেনে ডাক্তারি পড়তে পাঠিয়েছিলেন প্রাক্তন রেলকর্মী সোনারপুরের সুখেন্দু ঘরামি। ওডেসা ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী শ্রীমা ঘরামি বাড়ি ফিরেছেন অনেক কষ্টে। কিন্তু মাঝপথে তো আর ডিগ্রি ফেলে রাখা যায় না। তাই বাড়ি ফেরার পরেই তাকিয়ে রয়েছেন ছেড়ে আসা ইউক্রেনের দিকে। যুদ্ধে বিপর্যস্ত দেশেই তো ওঁর কলেজ, ওঁর হোস্টেল। রুমমেটদের সঙ্গে আবার দেখা হবে, আবার অ্যাপ্রন পরে ক্লাসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ, বাবার মতো শ্রীমাও চান যুদ্ধ থামলে ডিগ্রি শেষ করতে যাবেন পূর্ব ইউরোপের সুন্দর দেশটায়। সুখেন্দু বললেন, ‘‘এখন যা পরিস্থিতি তাতে সম্ভব না হলেও পরে যেতে তো হবেই।’’ কিন্তু মেডিক্যাল কলেজটাই যদি না থাকে! ইউরোপের অন্য দেশের কোনও মেডিক্যাল কলেজে ট্রান্সফার নেওয়ার ব্যবস্থা হতে পার কি না তা নিয়েও ভাবনা রয়েছে শ্রীমার। তবে আপাতত ক’টা দিন বিশ্রাম নিতে চান তিনি। কমপক্ষে অনলাইন ক্লাস কবে থেকে শুরু হয় তার অপেক্ষায় থাকা।
শ্রীমা বললেন, ‘‘চার বছর হয়ে গিয়েছে। বাকি আর দু’বছর। লেখাপড়া তো শেষ করতেই হবে।’’ একই সঙ্গে গত কয়েকটা দিনের কথাও বললেন শ্রীমা। মলডোভা সীমান্ত ক্রস করে রোমানিয়া পর্যন্ত পৌঁছতে তো কম কষ্ট হয়নি। বললেন, ‘‘বাড়ি থেকে ফিরে আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু আবার যাব। যেতে তো হবেই। এত কষ্ট দেখে নিয়েছি। না হয়, আরও একটু কষ্ট হবে।’’
একই সুর নাজিয়া রহমানের গলায়। জমিজমা বিক্রি করে বাবা গুলাম মুজিবর রহমান পাঠিয়েছিলেন ইউক্রেনে। বীরভূমের মুরারই গ্রাম থেকে অনেক দূর ইউক্রেনের কিভ। কথা হল নাজিয়ার সঙ্গে। তখন সবে হাঙ্গেরি হয়ে দিল্লিতে নেমেছেন। কিভ মেডক্যাল ইউনিভার্সিটির তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী বললেন, ‘‘ইউক্রেনে তৃতীয় আর ষষ্ঠ বর্ষের পরীক্ষা নিয়ে খুব কড়াকড়ি। পাশ করতেই হবে। আবার ফেরার কথা বাড়িতে গিয়ে সুস্থ হয়ে ভাবব।’’ শোনালেন, হস্টেল থেকে বের হয়ে কিলোমিটার তিনেক হেঁটে ট্রেন ধরার কথা। বোগজালনা থেকে লাবির। যুদ্ধের কারণে ৬ ঘণ্টার পথ পেরতে লেগেছে ১০ ঘণ্টা। এর পরে ৬ ঘণ্টার পথ ক্যাবে। দাহোনি সীমান্ত হয়ে হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট। তার পরে অনেকটা অপেক্ষা শেষে মেলে দেশে ফেরার বিমান। মেয়েকে নিতে অনেক আগে থাকতে কলকাতা বিমানবন্দরে চলে আসা নাজিয়ার বাবা বললেন, ‘‘মেয়ে ফিরছে। শান্তি পেলাম। কিন্তু আবার পাঠাতে হবে। ওর ভবিষ্যতের জন্যই পাঠাতে হবে। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় দেখা যাক।’’
একই রকম ভাবনা আয়ুষির মায়েরও। তবে এখনই মেয়েকে ফের বিভূঁইয়ে পড়তে পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানালেন না। বর্ধমানের উল্লাসের বাসিন্দ সবেই ইউক্রেন গিয়েছিলেন আয়ূষী অগরওয়াল। টের্নোপিল ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী বাড়িতে ফিরে এখন মানসিক ভাবে বেশ বিপর্যস্ত। মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ঠান্ডার মধ্যে অনেক পথ হেঁটে পৌঁছতে হয় পোল্যান্ড সীমান্তে। আয়ূষীর মা প্রীতি বললেন, ‘‘একটু সামলে উঠুক। তার পরে আমরা ঠিক করব কী করা যায়। ওর কলেজ কী বলে সেটাও দেখা যাক। আসলে মেয়েটার ডাক্তার হওয়ার খুব ইচ্ছা।’’ এই কথা শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল নাজিয়ার বলা একটা কথা। দিল্লি বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে টেলিফোন বলছিলেন, ‘‘ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। আমাদের কলেজ হয় তো ভেঙে দেবে। আমাদের স্বপ্ন তো আর ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া যাবে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy