Advertisement
০৮ নভেম্বর ২০২৪

কী ‘ইনটেনশন’ তোর, বলেই ধাক্কা মারল মহিলা কনস্টেবল

হাওড়া থেকে ৬.৫৫ মিনিটের মাতৃভূমি লোকালে বাড়ি ফিরছিলেন ওঁরা। ছিলেন সেই কামরায়, ট্রেন ছাড়ার মিনিট কুড়ির মধ্যে যার দরজা থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল সদ্য চল্লিশের যুবক দিপু শর্মাকে। কী হয়েছিল? মঙ্গলবার সন্ধ্যার ‘ভুলতে না-পারা’ সেই ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন ওঁরা— বিদিশা চক্রবর্তী এবং রিমিতা দাশগুপ্ত (নাম পরিবর্তিত)। দু’জনের বয়ানেই অভিযোগের আঙুল আরপিএফ-এর মহিলা কনস্টেবলের দিকে।হাওড়া থেকে ৬.৫৫ মিনিটের মাতৃভূমি লোকালে বাড়ি ফিরছিলেন ওঁরা। ছিলেন সেই কামরায়, ট্রেন ছাড়ার মিনিট কুড়ির মধ্যে যার দরজা থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল সদ্য চল্লিশের যুবক দিপু শর্মাকে। কী হয়েছিল? মঙ্গলবার সন্ধ্যার ‘ভুলতে না-পারা’ সেই ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন ওঁরা— বিদিশা চক্রবর্তী এবং রিমিতা দাশগুপ্ত (নাম পরিবর্তিত)। দু’জনের বয়ানেই অভিযোগের আঙুল আরপিএফ-এর মহিলা কনস্টেবলের দিকে।

দিপুর দেহ আঁকড়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন স্ত্রী। ছবি: দীপঙ্কর দে।

দিপুর দেহ আঁকড়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন স্ত্রী। ছবি: দীপঙ্কর দে।

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৫ ০৪:১৩
Share: Save:

বিদিশা বলছেন

খুব তাড়া না থাকলে মহিলা কামরাই আমার প্রথম পছন্দ। সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে গত তিন বছর ধরে এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসলে আমি যে স্টেশনে নামি (কোন্নগর), হাওড়া থেকে তার সময়ের দূরত্ব মেরে কেটে কুড়ি মিনিট। সাধারণ কামরায় উঠলে নামার সময়ে বড্ড ভিড় ঠেলতে হয়, তাই মহিলা কামরাই পছন্দ করি।

মঙ্গলবারও স্টেশনে এসে দেখি মাতৃভূমি দাঁড়িয়ে। উঠে পড়লাম। জায়গাও পেয়ে গেলাম। কানে গুঁজে নিলাম হেডফোন। ট্রেন ছাড়ল। হকারের হাঁকডাক এড়াতে ভল্যুম বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। চোখটাও বুজে এসেছিল এক সময়ে। তবে নিত্যযাত্রীদের একটা হিসেব থাকে, মিনিট পনেরো পর তাই চোখটা ঠিক খুলে গিয়েছিল। দেখি ট্রেন উত্তরপাড়া ছেড়ে যাচ্ছে। আর তখনই চোখে পড়ল বছর চল্লিশের এক ব্যক্তি ছুট্টে এসে কামরায় পা রাখলেন।

কামরায় আমরা জনা তিরিশ মহিলা যাত্রী ছাড়াও ছিলেন কয়েক জন মহিলা আরপিএফ কনস্টেবল। লোকটি কামরায় উঠতেই দুই কনস্টেবল তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন। হুকুম হল, ‘‘নেমে পড়।’’ একেবারে সরাসরি তুই-তোকারিতে চলে গেলেন ওঁরা। ট্রেন ততক্ষণে গতি বাড়িয়েছে। ভদ্রলোক পুলিশ কর্মীদের কাছে মিনতি করলেন, ‘‘পরের স্টেশনেই নেমে যাব, জরুর।’’ লোকটি মহিলা কামরায় ওঠায় প্রথমে যে বিরক্ত হইনি, তা নয়। কিন্তু তাঁর কথায় বোঝা যাচ্ছিল, ইচ্ছে করে নয়, ট্রেন ছেড়ে দেওয়ায় বাধ্য হয়েই উঠে পড়েছেন তিনি। তবে ওই মহিলা আরপিএফ নাছোড়— ‘‘নামবি কিনা বল?’’ এ বার তাঁর গলায় হুমকির সুর। কান থেকে হেডফোন খুলে ফেলি। অন্য দু’এক জনের সঙ্গে আমিও বলতে থাকি, ‘‘ছেড়ে দিন না, পরের স্টেশনেই নেমে যাবেন বলছেন তো...।’’ আরপিএফ কর্মীরা অবশ্য আমাদের কথায় কান দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না। এক মহিলা কনস্টেবল প্রশ্ন রাখলেন, ‘‘নেমে তো যাবি, আগে বল্ এই কামরায় উঠেছিস কেন? জানিস না, এটা লেডিজ স্পেশ্যাল!’’ লোকটিকে বলতে শোনা যায়, ‘‘ম্যাডাম, ভুল করে উঠে পড়েছি। পরের স্টেশনেই নেমে যাব। প্লিজ।’’ তাতে অবশ্য মন গলল না ওই কনস্টেবলের, উল্টে বেশ নোংরা ভাষায় গালমন্দ শুরু করলেন। ওই মহিলার ভাবভঙ্গি দেখে আমরা আবার বলি, ‘‘ছেড়ে দিন না! উনি তো বলছেন, ভুল হয়ে গিয়েছে।’’ এ বার আমাদের দিকে ফিরে ওই কনস্টেবল পাল্টা তোপ দাগলেন, ‘‘খুব দরদ দেখছি! চুপ করে বসুন। আমাদের কাজ আমাদের বুঝে নিতে দিন।’’ বলেই দু’পা এগিয়ে গিয়ে লোকটিকে বলতে শুরু করলেন, ‘‘উঠলেই বলিস ভুল করে উঠেছি। কী ইনটেনশন রয়েছে আমরা জানি না?’’ লোকটি কাকুতি-মিনতি করেই যাচ্ছিলেন, ‘‘বিশ্বাস করুন, সত্যিই ভুল করে উঠে পড়েছি দিদি।’’ মিনিট দেড়েকের এই কথোপকথনের মাঝে ওই মহিলা কনস্টেবল এ বার আচমকা ধাক্কা মারলেন লোকটিকে। পড়ে যেতে গিয়েও ভদ্রলোক রডটা আঁকড়ে ধরলেন এক বার।

পড়ুন: কনস্টেবলের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু

ফের ধাক্কা। আর টাল সামলাতে পারলেন না। একটা তীব্র চিৎকার আর ট্রেনের হুইসল মিলেমিশে গেল। নিমেষে কামরা থেকে হারিয়ে গেল একটা মানুষ।

ভীষণ নার্ভাস লাগছিল। হাত-পা কেমন ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। আমি কেঁদে ফেললাম। ততক্ষণে অন্য মহিলা যাত্রীরা ওই পুলিশ কর্মীকে জাপটে ধরেছেন। ট্রেন ঢুকে পড়েছে হিন্দমোটর স্টেশনে। আমি প্ল্যাটফর্মে নেমে ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লাম।

রিমিতার কথায়

নাচ শিখিয়ে বেড়াই। উত্তর থেকে দক্ষিণ, কলকাতার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটোছুটি করতে হয়। তাই সব সময়ে তাড়া থাকে। মঙ্গলবারও ছিল।

টালিগঞ্জে ক্লাস সেরে বাড়ি ফেরার জন্য হাওড়ায় পৌঁছে দেখি, মাতৃভূমি ছাড়ছে। পড়ি কি মরি করে বোনকে নিয়ে উঠে পড়লাম। কামরায় উঠেই নজরে পড়েছিল অন্তত জনা তিনেক মহিলা আরপিএফ কর্মীর দিকে। তখন ভাল করে খেয়াল করিনি। হিন্দমোটরে নামতে হবে, তাই উত্তরপাড়া আসতেই দরজার কাছে এগিয়ে গিয়েছিলাম।

ট্রেন ছাড়তেই দেখি মাঝবয়সী একটি লোক দৌড়ে এসে কামরায় উঠলেন। নিমেষে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন এক মহিলা কনস্টেবল। এ বার খেয়াল করলাম। দেখলাম অন্যরা ততটা আক্রমণাত্মক না হলেও, এক জন কনস্টেবল সটান তুইতোকারি শুরু করলেন! ‘‘নাম, নেমে যা বলছি!’’ লোকটি বিনীত ভাবে বলতে থাকেন, ‘‘ভুল করে উঠে পড়েছি। পরের স্টেশনেই নেমে যাব।’’ ওই কনস্টেবলের অবশ্য লোকটির কথা শোনার মতো ধৈর্য্য ছিল না। তিনি সমানে বলতে থাকেন, ‘‘নেমে যা, নাম বলছি।’’

পড়ুন: কী করে সামাল দেবেন, কেঁদেই যাচ্ছেন দিপুর স্ত্রী

আমার তখন নামার তাড়া। দেখলাম গেটের কাছে ওই লোকটিকে ধাক্কা দিতে শুরু করলেন ওই কনস্টেবল। লোকটি প্রাণপণে ট্রেনের হাতল আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। হঠাৎ মনে হল লোকটির হাত ছেড়ে গেল।

আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম। অবাক হয়ে দেখি, লোকটি পড়ে যেতেই ওই কনস্টেবল— যেন কাজ হয়ে গিয়েছে— এমন ভঙ্গিতে এসে সিটে বসে পড়লেন। এক মুহূর্তের স্তব্ধতা। তার পরেই কামরার অন্য মহিলা যাত্রীরা প্রায় ছুটে এসে জাপটে ধরলেন ওই পুলিশ কর্মীকে। গোটা কামরা জুড়ে চিৎকার-চেঁচামেচি। ট্রেন ততক্ষণে ঢুকে পড়েছে হিন্দমোটরে। আমার পা চলছিল না। এমন নিষ্ঠুরতারও সাক্ষী হতে হল!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE