নথি প্রকাশ করছেন মুখ্যমন্ত্রী। — নিজস্ব চিত্র।
নাইট রাইডার্স যুগের ঢের আগে থেকে বাংলার মন্ত্রী ও সচিবেরা প্রবল ক্রিকেট-উৎসাহী। ১৯৪১ সালের ১৯ জানুয়ারি এলগিন রোডের বাড়ি থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধানের দু’সপ্তাহ আগের কথা। মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হল, যুদ্ধ তহবিলে টাকা তুলতে শনিবার, ৪ জানুয়ারি ছুটির দিন ভাইসরয় একাদশ বনাম গভর্নর একাদশ ক্রিকেট ম্যাচ হবে। রাজ্যের মুখ্যসচিব ছোট্ট আপত্তি জানালেন, ‘‘তা হলে ৪ তারিখ সবাই রাইটার্সে এসে সই করুক। তার পর তারা আগে বেরিয়ে না হয় খেলা দেখতে যাক। নইলে অন্য অফিসে আপত্তি উঠবে।’’
১৯৩৯। নেতাজি তখন সর্বভারতীয় রাজনীতিতে গাঁধীজির প্রতিদ্বন্দ্বী। দু’বছর বাদে এলগিন রোডের বাড়ি থেকে অন্তর্ধান, তাঁর মেজদা শরৎ বসুও তখন মন্ত্রিসভায় নেই, তিনি বিধানসভার সদস্য। তার আগে বসু ভাইদের ইচ্ছে সত্ত্বেও ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে জোট সরকারে যেতে পারেনি কংগ্রেস। গাঁধীকে অভিমানভরে চিঠি দিয়েছিলেন সুভাষ, ‘‘আপনি আমাদের কথা না শুনে মৌলানা আবুল কালাম, বিড়লা আর নলিনীকান্ত সরকারের কথায় সিদ্ধান্ত নেন কেন?’’
এ সব ইতিহাস বহুপরিচিত। সোমবার রাজ্য সরকারের তরফে প্রকাশ হওয়া নতুন একগুচ্ছ ডিক্লাসিফায়েড ফাইল থেকে আসলে বেরিয়ে আসছে বাংলার মন্ত্রিসভার মানসিক ইতিহাস। পরাধীন ভারতের শেষ দশ বছরের (১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭) মন্ত্রিসভার বৈঠকের সমস্ত নথি প্রকাশ করে এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘আশা করি এ সব দেখে ইতিহাসবিদ, গবেষক শিক্ষক-ছাত্রসমাজ উপকৃত হবে।’’ এ দিন প্রকাশ হওয়া ৪১৮টি নথির পর স্বাধীনতা-পরবর্তী ১০ বছরের সমস্ত নথিও প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হওয়া নেতাজি সংক্রান্ত ৬৪টি ফাইলের সিডি আজ, মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দেবেন মুখ্যমন্ত্রী। নবান্নে তিনি বলেছেন, ‘‘আমি মনে করি, আমরা যে পদক্ষেপ করেছি সেটা পরবর্তী কালে সবাই করবে। ডকুমেন্টেশন মানে তো হৃদয়। সেটাই প্রামাণ্য (এভিডেন্স)। মুখে একটা কথা বলা যায় আর তথ্য (ডকুমেন্ট) দিয়ে বললে সেটা চিরস্থায়ী হয়ে যায়।’’
গত দু’সপ্তাহ ধরে ইতিহাসের একের পর এক প্রামাণ্য নথি গোপনীয়তার অন্ধকার থেকে উঠে এল জনতার নাগালে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী তাঁর সদ্যপ্রকাশিত বইয়ে দেখিয়েছেন, বিশ শতকে যদুনাথ সরকারের আমল থেকে ভারতে ইতিহাস এ ভাবেই গড়ে উঠেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে, জন পরিসরের তর্কে। মমতার ফাইল প্রকাশকে নরেন্দ্র মোদী সরকারের ওপর চাপের বদলে তিনি দেখছেন অন্য ভাবে। বলছেন ‘‘ডিসপ্লেসড ট্রান্সপারেন্সি। মমতা বোঝাতে চান, আমি স্বচ্ছ। অতীতের সব কাগজ বের করে দিচ্ছি। ওঁর কাছে মূল্যবান এটাই। অতীতকে স্বচ্ছ করে জনগণকে বোঝানো, আমিও স্বচ্ছ। এটাই স্বচ্ছতার রাজনীতি।’’
মুখ্যমন্ত্রীর যদিও যুক্তি, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় যা গোপন ছিল, আজ তা গোপন না-ও হতে পারে। তাই এগুলি মানুষের সামনে তুলে ধরাই উচিত। এই নথি রাখা থাকবে রাজ্য সরকারের মহাফেজখানায়। চমকপ্রদ তথ্যে ঠাসা সে সব নথি!
১৯৪৬ সালের ১৬ অগস্ট কলকাতায় দাঙ্গার পর ২ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠক। দাঙ্গায় ডাকব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, রেশন দোকানে লুঠতরাজ চলছে ইত্যাদি আলোচনা। রাজস্বসচিব জানালেন, বাংলার ডিস্টিলারিগুলিতে বছরে ৬ লক্ষ মণ ঝোলাগুড় লাগে। বর্তমান আইনের বলে ৩ লক্ষ মণ আসে বিহার থেকে, ২ লক্ষ উত্তরপ্রদেশ থেকে। বিহার ও উত্তরপ্রদেশ এই কোটা কমিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছে। ‘ভারত রক্ষা আইন’-এর অন্যতম ধারায় ছিল এই ‘কোটা’র কথা। এ দিকে সেপ্টেম্বরেই ভারত রক্ষা আইনের মেয়াদ ফুরোনোর কথা ছিল। রাজস্বসচিব জানান, আইনটির মেয়াদ এখনই বাড়াতে হবে। ঝোলাগুড় এবং মদ থেকে পাওয়া আবগারি শুল্ক তখনও বাংলার রাজকোষের অন্যতম ভরসা।
খবরের কাগজকেও কড়া হাতে কব্জা করার কথা ভেবেছেন বাংলার মন্ত্রীরা। ১৯৪২ সালের অগস্ট মাসে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন শুরুর পর ১ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে ফজলুল হক, ঢাকার নবাব হাজিবুল্লা হাজির। কথা হল, খবরের কাগজ সরকারকে ‘মিসরিপ্রেজেন্ট’ করছে। অর্ডিন্যান্স দরকার। রাজস্ব সচিব বললেন, অর্ডিন্যান্সের পর সাপ্লিমেন্টারি বিল আনতে হবে। প্রাদেশিক আইনসভায় সেই বিল পাশ করানো যাবে না। অতঃপর অর্ডিন্যান্স নিয়ে আর কথা হল না। শুধু অর্ডিন্যান্সে হয় না, বিল পাশ করানোর মতো শক্তিও যে থাকা চাই, সেই ’৪২ সালেই উপলব্ধি করেছিল বাংলার মন্ত্রিসভা।
গোলমালের চোটে মহাযুদ্ধের সময় ১৯৪১ সালের ৪ অগস্ট সন্ধ্যায় বিধানসভায় মুলতুবি প্রস্তাব আনা হয়। ৫ অগস্ট সকালে মন্ত্রিসভার রিপোর্ট জানাচ্ছে, স্পিকার চেয়ার ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সভা এক ঘণ্টা স্থগিত ছিল। গোলমালের চোটে পুরসভা সংশোধন বিল আনা যাচ্ছিল না। স্বরাষ্ট্রসচিবের মত ছিল, বিধানসভার চলতি নিয়মকানুন এই জাতীয় সংগঠিত গণ্ডগোল থামানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়। স্পিকার বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও এক জন সদস্য তাঁকে অমান্য করে চেয়ারে বসে আছেন, ভাবা যায় না।
১৯৪১ সাল। ফজলুল হকের আমলে বিরোধী নেতা তখন শরৎ বসু। হার্ভার্ডে ধরা গেল তাঁর নাতি, ইতিহাসবিদ সুগত বসুকে। বললেন, ‘‘আমি এই কাগজগুলি দেখিনি, কিন্তু গভর্নর তখন মন্ত্রিসভার সঙ্গে আলোচনা করে দিল্লিতে বিশদ রিপোর্ট পাঠাতেন। সেগুলি সব লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে পড়েছি।’’
ইতিহাসের বহু অধ্যায় এ ভাবেই চোখের সামনে। ১৯৩৮ সালের পয়লা মার্চ মন্ত্রিসভার মিটিংয়ে ফজলুল হক জানাচ্ছেন, আগামী ১০ তারিখ গাঁধীজি কলকাতায় আসবেন। তার আগে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হোক। পরোক্ষ ইতিহাসে ফের চলে এলেন সুভাষ। সুগত তাঁর ‘হিজ ম্যাজেস্টিজ অপোনেন্ট’ বইতে দেখিয়েছিলেন, ওই সময় গাঁধীজি, নেহরু সবাই এলগিন রোডে। ডিনার হয় শরৎ বসুর উডবার্ন পার্কের বাড়িতে। নেহরু মন্তব্য করেন, ‘‘ওফ, শরতের ডিনার মানে নুইসেন্স। গাদা গাদা খাবার এসেই যাচ্ছে।’’ ওই ফাইলেই আছে, মন্ত্রিসভার আলোচ্য বিষয়: বেঙ্গল টেন্যান্সি বিল। ফজলুল হকের আনা এই বিল-ই সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের রাজ্যে প্রথম ‘রায়তের’ স্বার্থে বিধানসভায় আনা বিল। ১১ অগস্ট, ১৯৪৭। সকাল ১০টায় মন্ত্রিসভার অধিবেশন। ত্রাণকর্তা ডেভিস জানালেন, ছিন্নমূলরা বর্ধমান ছেড়ে মুর্শিদাবাদের দিকে যাচ্ছেন। এ দিকেও ছিন্নমূলরা আসছেন। মন্ত্রী কমলকৃষ্ণ রায় জানালেন, ত্রাণ দফতর জেলায় ১৫ টন আলু পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মহেশখালিতে ২০ হাজার মণ ধান লুঠ হয়েছে। ফেনি এবং নানা জায়গায় বন্যা।
আলোচনার শেষে ছোটলাট বারোজ জানালেন, ১৪ অগস্টের পর সকলের মেয়াদ শেষ। কাউকে ইস্তফা দিতে হবে না। তাঁরা functious officio হিসেবে পরিগণিত হবেন। লাতিন শব্দবন্ধ উল্লেখেই শেষ হল বাংলার প্রাদেশিক আইনসভা।
অতঃপর অন্য ইতিহাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy