তিস্তার জলে গত চার বছর ক্রমশই ঘোলা হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ঢাকার সম্পর্ক। তাতে আরও ইন্ধন জুগিয়েছে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণ। ভাষা দিবসের ঐতিহাসিক আবেগকে কাজে লাগিয়ে প্রায় তলানিতে পৌঁছে যাওয়া সম্পর্ক চাঙ্গা করার লক্ষ্যে আগামী কাল সন্ধ্যায় ঢাকার শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে পা রাখবেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। সঙ্গে পাত্র-মিত্র-অমাত্যদের বিরাট দল।
তিস্তার জলবণ্টনের বিরোধিতা করেই ২০১১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে ঢাকা সফর শেষ প্রহরে বাতিল করেছিলেন মমতা। পদ্মাপারে তাঁর প্রতি বিরূপ মনোভাবের সেটাই সূত্রপাত। খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণ এবং জামাতের সন্ত্রাসে তৃণমূল সাংসদের যুক্ত থাকার অভিযোগ যাকে আরও তীব্র করেছে। এ খবর অনিবার্য ভাবেই পৌঁছেছে মমতার কানে। পরিস্থিতি সামাল দিতে তাই বারে বারে ঢাকা সফরে আসতে চেয়েছেন তিনি। কখনও ফিরোজা বেগমকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে, কখনও অন্য কোনও উপলক্ষে। কিন্তু কী দিল্লি, কী ঢাকা কোনও তরফেই সাড়া মেলেনি।
এর পর প্রায় আচমকাই ছিটমহল হস্তান্তর নিয়ে আপত্তি প্রত্যাহার করে নেন মমতা। তাঁর এই বদলে যাওয়া মনোভাব দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পক্ষে সহায়ক হবে বুঝেই এ বার ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে মোদী সরকার। মমতার এই সফরে ঢাকার পাশাপাশি তাই দিল্লির অবদানও কম নয়। সূত্রের খবর, গত বছর বাংলাদেশ সফরে যাওয়ার আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করেছিলেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। ঢাকার পাশাপাশি বিদেশ মন্ত্রকেরও আশা, এই সফরকে স্মরণীয় করে রাখতে সক্রিয়তা থাকবে মমতার তরফেও। তিস্তার জলবণ্টন চুক্তিতে সায় দেওয়া নিয়ে একেবারে পাকাপাকি কোনও ঘোষণা করুন বা না-করুন, একটু নমনীয়তার ইঙ্গিতও যদি দেন মমতা, সেটাকেই বড় প্রাপ্তি বলে মনে করা হবে। কারণ, লোকসভা ভোটের আগে উত্তরবঙ্গে প্রচারে গিয়ে তিস্তা চুক্তির বিরুদ্ধেই কথা বলেছিলেন তিনি।
কিন্তু তার পরে এই ন’মাসে পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টেছে। তৃণমূলের এক রাজ্যসভার সাংসদের সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনের যোগাযোগ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ওই সাংসদের হাত দিয়ে সারদা কেলেঙ্কারির অর্থ চোরাপথে বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনের কাছে পৌঁছেছে, এমন অভিযোগও উঠেছে। খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণে বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠনের হাত প্রকাশ্যে আসায় আরও অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে মমতাকে। পশ্চিমবঙ্গে ক্রমশ শক্তি বাড়ানো বিজেপি যে গোটা বিষয়টিকে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রচারে ব্যবহার করবে, এটা টের পেয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।
সেই কারণে হাসিনা সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার মমতার কাছে জরুরি হয়ে পড়েছে বলে অনেক রাজনীতিকের মত। তাঁরা বলছেন, মমতা জানেন, তাঁর বিরুদ্ধে এই প্রচার ভোটারদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। দেশভাগের ফলে চলে আসা রাজ্যের একটা বড় অংশের মানুষের মননে এখনও বাংলাদেশ নিয়ে একটি আবেগ কাজ করে। ঢাকার সঙ্গে সদা সংঘর্ষের পথে চললে, সেই আবেগও বিরুদ্ধে যেতে পারে। মমতার অবস্থান বদলের মূল কারণ এটাই, বলছেন ওই রাজনীতিকরা।
আর দিল্লিতে বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, সেই না-যাওয়ার পরে মমতার এই যে ঢাকা যাওয়া এটাই তো একটা ইতিবাচক বিষয়! বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামি লিগ নেতারাও বলছেন, মমতার ঢাকা আসার আগ্রহটাই প্রমাণ করে যে তিনি তিস্তা নিয়ে আলোচনায় প্রস্তুত। কারণ, পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ মমতা ভালই জানেন যে, এই মুহূর্তে ভারত-বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্লাইম্যাক্স হল তিস্তা। আগামী ২০ তারিখ মমতার সঙ্গে বৈঠক করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং রাষ্ট্রপতিআব্দুল হামিদ। এই আলোচনার টেবিলে পদ্মার ইলিশ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানাবেন মমতা। আর ঢাকার তরফে যে তিস্তা চুক্তির কথাই বলা হবে সে ব্যাপারে সচেতন তিনি। ঢাকা চায়, এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তিস্তার জলবণ্টন চুক্তি নিয়ে ইতিবাচক কোনও ঘোষণা করুন মমতা।
তিস্তা নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে দু’টি বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে হাসিনা সরকার। এক, নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের রিপোর্ট। সমস্ত মরসুমের তিস্তার প্রবাহ খতিয়ে দেখে তাঁকে রিপোর্ট প্রস্তুত করতে বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সূত্রের খবর, সেটি তিনি জমা দিয়ে দিয়েছেন। দুই, সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার পঙ্কজ সারন সম্প্রতি কলকাতা গিয়ে কল্যাণবাবুর সঙ্গে গোটা বিষয়টি নিয়ে কথা বলে এসেছেন। এই রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে জলবণ্টনের ব্যাপারে একটা ইতিবাচক পথ বেরিয়ে আসবে বলেই ঢাকা আশাবাদী। পাশাপাশি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সফরটিকে বিজ্ঞাপন করে বাংলাদেশ জুড়ে তাণ্ডব চালানো মৌলবাদী জামাতে ইসলামির বিরুদ্ধে বার্তা দিতে চায় তারা।
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রে খবর, গত তিন মাস ধরেই বাংলাদেশ সফরের আগ্রহ দেখিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করেছিলেন মমতা। নভেম্বরে বাংলাদেশ থেকে আসা সংসদীয় প্রতিনিধি দলের কাছেও তিনি এ বিষয়ে উৎসাহ দেখান। ডিসেম্বরে দিল্লি ও কলকাতা সফরে আসা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদকেও মমতা জানিয়েছিলেন তিনি ঢাকা যেতে চান। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এই সময়েই বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তিটি নিয়ে আপত্তি তুলে নেন মুখ্যমন্ত্রী। এই সফরের আগে তিন দিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলে বন্দি বাংলাদেশিদের মুক্তি দিয়েছে রাজ্য সরকার। এটিও অবশ্যই একটি মৈত্রীর সঙ্কেত!
বাংলাদেশ সরকার সূত্রে জানা গিয়েছে, শহিদ মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ্য এবং শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক ছাড়াও ঢাকা বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর যাওয়ার কথা মুখ্যমন্ত্রীর। রিকশা করে শহর ঘোরারও ইচ্ছা রয়েছে তাঁর। তবে গত দেড় মাস ধরে যে ভাবে বিরোধীরা হরতাল ও হিংসা চালিয়ে আসছে, তাতে তাঁর সে ইচ্ছে মিটবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। শেখ মুজিবর রহমানের নামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি চেয়ার চালু করার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ওই চেয়ারটির উদ্বোধনে হাজির থাকতে কলকাতায় আমন্ত্রণ জানাবেন মমতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy