জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সমাবেশে সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার শহিদ মিনারে। ছবি: সুদীপ আচার্য।
গত বছর নভেম্বরে সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে ‘আমরা সবাই চোর’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে কলকাতার রাস্তায় মিছিল করেছিলেন তিনি। ঠিক এক বছর পরে কেন্দ্রীয় সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই বলতে শোনা গেল, ‘‘আমার পিছনে কেউ যদি সিবিআই লাগায়, লাগাক! জেলে যেতে আমি ভয় পাই না। জেলে নিয়ে গেলে তো ভালই! জেলে গেলে কয়েক দিন বিশ্রাম পাব!’’
অসহিষ্ণুতা, ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদ এবং জাতীয় অখণ্ডতা নষ্ট করার চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের আমন্ত্রণে বৃহস্পতিবার শহিদ মিনার ময়দানের সমাবেশে উপস্থিত হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর হঠাৎ এমন মন্তব্য চাঞ্চল্য তৈরি করেছে সব মহলে!
মুখ্যমন্ত্রী যদিও সারদা-প্রসঙ্গ এক বারও তোলেননি। বরং অভিযোগ করেছেন, অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললেই তাঁদের পিছনে নানা তদন্তকারী সংস্থাকে লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, অসহিষ্ণুতা-বিতর্কে কারও জেলে যাওয়ার ঘটনা তো ঘটেনি! তা হলে মমতা হঠাৎ এমন কথা বলতে গেলেন কেন? তাঁর কথায় কি নেহাতই রাজনীতির ধোঁয়া? নাকি এর পিছনে আসলে আগুনও আছে? বিরোধীরা বলতে শুরু করেছেন, মুখ্যমন্ত্রী কি জেলে যাওয়ার ভয় পাচ্ছেন? সারদা-কাণ্ড সামনে আসতেই যেমন তিনি বলে ফেলেছিলেন ‘কুণাল চোর? মদন চোর? মুকুল চোর? আমি চোর?’ এ বারও কি সেই উপসর্গের পুনরাবৃত্তি? কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের টিপ্পনী, ‘‘এটা কি ‘ঠাকুরঘরে কে আমি কলা খাইনি’ হয়ে গেল না?’’
মুখ্যমন্ত্রীর আশঙ্কা ও অস্বস্তি অবশ্য একেবারে অমূলক নয়! জামিন খারিজ হওয়ার পরে মমতার সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্রকে ইতিমধ্যেই ওড়িশায় নিয়ে গিয়ে জেরা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সিবিআই। ফের তলব করা হয়েছে তৃণমূলের তরুণ নেতা শঙ্কুদেব পণ্ডাকেও। সম্ভবত আজ, শুক্রবারই তিনি হাজির হতে পারেন সিবিআইয়ের সিজিও কমপ্লেক্সে। এতেই শেষ নয়। সিবিআই সূত্র বলছে, সারদা ও রোজ ভ্যালি মামলায় শাসক দলের আরও আট জন নেতাকে জেরার জন্য নোটিস পাঠানো হতে পারে। এই নেতাদের পাঁচ জনকে আগে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তালিকায় চার জন এমন নেতাও রয়েছেন, যাঁদের আগে কখনও ডাক পড়েনি। এর মধ্যে রাজ্যের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এক সাংসদও রয়েছেন বলে সিবিআই সূত্রের ইঙ্গিত। এবং বিধানসভা ভোটের আগে এই ইঙ্গিতের সূত্র ধরেই সম্ভবত এ দিন আগাম কেন্দ্র-বিরোধী জিগির তুলেছেন মমতা।
সিবিআই সূত্রের খবর, কলকাতার দফতর থেকে ওই তৃণমূল নেতাদের সম্পর্কে একটি তথ্যভাণ্ডার তৈরি করে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার অধিকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে। ওই নেতারা কী ভাবে সারদা ও রোজ ভ্যালির সঙ্গে যুক্ত, তার অনেক তথ্যপ্রমাণও সেখানে রাখা হয়েছে বলে তদন্তকারীদের দাবি। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, অনেক সাক্ষীকে জেরা করার সময়েও তৃণমূলের কিছু নেতার নাম উঠে এসেছে। সেই সব বয়ানও অধিকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে। গোপনে ওই সব তৃণমূল নেতার আয়কর রিটার্ন, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্য যাচাই করেছেন তদন্তকারীরা। তাতে দেখানো হয়েছে, কয়েক বছরে ওই সব নেতার সম্পত্তির পরিমাণ কতটা বেড়েছে!
সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, সারদা ও রোজ ভ্যালির মতো অর্থলগ্নি সংস্থার তদন্ত রাজনৈতিক ভাবে যথেষ্ট স্পর্শকাতর। তাই কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করার আগে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করেই নোটিস পাঠানো হয়। এ সব নথি জোগাড় করতে যথেষ্ট সময়ও লেগেছে। সিবিআই সূত্রের আরও ইঙ্গিত, আপাতত ন’জন নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও পরে এই তালিকা দীর্ঘতর হবে। সিবিআই সূত্রের দাবি, এর আগে জেরার মুখে তৃণমূলের কিছু নেতা যে সত্য বয়ান দেননি, তার পক্ষে তথ্যপ্রমাণ জোগাড় হয়েছে। এ বার তথ্যপ্রমাণ সামনে রেখে ওই নেতাদের জেরা করা হতে পারে। বয়ানে অসঙ্গতি পেলে ওই নেতাদের গ্রেফতারের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
বস্তুত মদনের গ্রেফতারির পরে তৃণমূলের তৎকালীন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়কে জেরা করে ছেড়ে দিয়েছিল সিবিআই। তার পর থেকেই তদন্তের গতি কিছুটা শ্লথ বলে অভিযোগ উঠেছে। যার জেরে বাম এবং কংগ্রেস বলে এসেছে, মোদী-দিদির বোঝাপড়ার জন্যই সিবিআই ধীরে চলছে! যদিও তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, তথ্যপ্রমাণ হাতে নিয়ে খুব সতর্ক হয়ে এগোতে হচ্ছে বলেই সময় লাগছে। কিন্তু তার পাশাপাশি এটাও সত্যি যে, বিধানসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সিবিআই ফের তৎপর হলে তার পিছনে রাজনৈতিক অঙ্ক খুঁজে পাওয়া অস্বাভাবিক নয়।
ঠিক সেই কাজটাই এ দিন থেকে শুরু করে দিয়েছেন মমতা। দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্তদের তিনি আড়াল করার চেষ্টা করছেন— জনমানসে এই বার্তা যাতে না যায়, তার জন্য কৌশলে অসহিষ্ণুতা-বির্তকের সঙ্গে গোটা বিষয়টিকে জড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। জমিয়তের সমাবেশ থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, কেউ কোথাও অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে মুখ খুললেই তাঁদের ভয় দেখানো হচ্ছে। ইডি বা সিবিআইকে লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শাহরুখ খান, আমির খান, এ আর রহমানদের সঙ্গেই তিনি টেনে এনেছেন মিঠুন চক্রবর্তীকেও। মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, ‘‘মিঠুন চক্রবর্তী আমার সঙ্গে কথা বলতে ভয় পায়। সে আমাদের সাংসদ। এমন করে ভয় দেখিয়ে রেখেছে!’’ এই সূত্র ধরেই নিজের জেলে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা আগাম বলে রাখেন তিনি। কথার মোড়কটা অসহিষ্ণুতা নিয়ে হলেও, এর গভীরে সারদা-আতঙ্কই খুঁজে পাচ্ছেন বিরোধীরা। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রর কটাক্ষ, ‘‘জেলের ভিতরে থাকুন বা বাইরে, লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতারিত হওয়ার দায় মুখ্যমন্ত্রীকেই নিতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy