পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় ভোটার তালিকায় ‘ভূতুড়ে’ ভোটার ঢুকিয়ে দেওয়ার অভিযোগ কয়েক দিন আগেই করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার নেতাজি ইন্ডোরে তৃণমূলের সর্বস্তরের নেতাদের বৈঠকে সেই ‘ভূত’ তাড়ানোকেই এই মুহূর্তের ‘একমাত্র কাজ’ বলে উল্লেখ করলেন দলের সর্বময় নেত্রী। সেই কাজ করতে গোটা সংগঠনকে ময়দানে নামার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি হুঁশিয়ারির সুরে এ-ও বলে দিলেন, যে জেলা সভাপতিরা ওই কাজে অনীহা দেখাবেন, তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হবে। মমতার কথায় স্পষ্ট, ভোটার তালিকার উপরেই নির্ভর করছে ভোটের ভবিষ্যৎ।
বৃহস্পতিবার নেতাজি ইন্ডোরের মহাসমাবেশ থেকে আগামী বিধানসভা ভোটের রণদুন্দুভি বাজিয়ে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের তিন বারের মুখ্যমন্ত্রী। স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তাঁর নিশানায় এ বার কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন। আর তাঁর ‘পাখির চোখ’ ভোটার তালিকা। মমতার কথায়, ‘‘নির্বাচন কমিশনের আশীর্বাদ নিয়ে দিল্লি, মহারাষ্ট্রের মতো বাংলাতেও ফিল্ড সার্ভে না করে এআরও-র সাহায্যে অপারেটরদের কাজে লাগিয়ে অনলাইনে ভুতুড়ে ভোটারদের নাম তোলা হচ্ছে। বাংলার ভোটারের একই এপিক কার্ডে হরিয়ানা, গুজরাতের লোকের নাম তুলছে!’’ উদাহরণ দিয়ে মমতা বলেন, ‘‘মুর্শিদাবাদের রানিনগরে কোনও ভোটারের এপিক নম্বরে হরিয়ানার কারও নাম তোলা হয়েছে। উত্তরবঙ্গের গঙ্গারামপুরেও কারও এপিক নম্বরে নাম উঠেছে গুজরাতের লোকের।’’ মমতার অভিযোগ, এই কাজ করেই মহারাষ্ট্র এবং দিল্লিতে বিজেপি ক্ষমতা দখল করেছে।
নিজের ভাষণে সরাসরি সদ্যনিযুক্ত মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগকে কাঠগড়ায় তুলেছেন মমতা। বলেছেন, বর্তমান মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ‘ঘনিষ্ঠ’। তিনি এক সময়ে গুজরাতে শাহের অধীন সমবায় দফতরের সচিব পদে কাজ করেছেন। কমিশনের উদ্দেশে মমতা বলেন, ‘‘আমি নির্বাচন কমিশনকে শ্রদ্ধা করতাম। এখনও করি। কিন্তু দিল্লির ইলেকশন কমিশন অফিসে বসে আধার কার্ড কেলেঙ্কারি করে একই এপিক নম্বরে বাংলার ভোটারের নামের সঙ্গে রাজস্থান, বিহার, হরিয়ানার ভোটারের নাম যুক্ত করা হচ্ছে।’’
আরও পড়ুন:
কমিশনকে সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়ে তৃণমূল নেত্রী বলেছেন, ‘‘আমরা যদি এখানে ২৬ দিন অনশন করতে পারি, তা হলে কমিশনের দফতরের সামনে ধর্নাও দিতে পারি।’’ তাঁর অভিযোগ, দু’টি সংস্থাকে ব্যবহার করে বিজেপি ভোটার তালিকায় ‘ভুতুড়ে’ ভোটারদের নাম ঢুকিয়ে দিচ্ছে। নিজের অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ দিতে মমতা সভায় কয়েকটি নির্দিষ্ট উদাহরণও পেশ করেন নাম ধরে ধরে। মমতার নির্দেশ যে অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে, তা স্পষ্ট নেত্রীর বক্তব্যের অব্যবহিত পরেই উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদয়ন গুহর বার্তা, ‘‘যারা ভোটার তালিকায় জল মেশাতে আসবে, তাদের হাঁটুতে জল জমানো হবে।’’
বৃহস্পতিবার দলকে মমতা নির্দেশ দিয়েছেন, শুক্রবার থেকেই ওই কাজে নেমে পড়তে হবে। কোনও ফাঁক রাখা যাবে না। সন্দেহ নেই যে, বুথস্তরে ওই কাজ ‘যথাযথ’ ভাবে হলে বিধানসভা ভোটের আগে সার্বিক ভাবে তৃণমূলের সংগঠনেও ‘নাড়াচাড়া’ পড়বে। জেলায় জেলায় সাংগঠনিক ভাবে যে কাজ হবে, তিন দিন অন্তর তৃণমূল ভবনে তার রিপোর্ট পাঠাতে হবে জেলা সভাপতিদের। রাজ্য স্তরে একটি কমিটিও তৈরি করে দিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। সুব্রত বক্সীর নেতৃত্বে ৩৫ জনের সেই কমিটি পালা করে তৃণমূল ভবনে বসবে।
মমতা জানিয়েছেন, এই বিষয়টি সম্পর্কে তাঁকে সর্বপ্রথম সতর্ক করেছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ সাগরিকা ঘোষ। তৃণমূলনেত্রী বলেন, ‘‘আমাদের রাজ্যসভার সাংসদ সাগরিকা ঘোষ প্রথম আমাকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছিল। তার পরেই খোঁজ নিতে গিয়ে সবটা জানতে পারি। মানুষকে বলব, আপনারাও ভোটার তালিকায় নিজেদের নামটা ঠিক আছে কি না দেখে নিন। ওদের লক্ষ্য দুটো। এক, ভূতুড়ে ভোটার ঢুকিয়ে তৃণমূলকে হারানো আর দুই, বাংলার মানুষকে ছাঁটাই করে দেওয়া।’’
আরও পড়ুন:
প্রসঙ্গত, একটা সময়ে বামেরা পাড়ায় পাড়ায় বাড়ি ধরে ভোটার তালিকা ‘স্ক্রুটিনি’ করার কাজ করত। অনিল বিশ্বাস রাজ্য সম্পাদক থাকাকালীন সেই কাজকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল সিপিএম। এখন তৃণমূলের স্থানীয় স্তরের নেতারা পাড়ায় কোন বাড়িতে কারা আছেন, কেউ প্রয়াত হয়েছেন কি না বা কোন ভাড়াটিয়া কোন এলাকা থেকে চলে গেলেন, সে সব খোঁজখবর রাখেন। তবে মমতা যে কাজের নির্দেশ দিয়েছেন, তা শুধু পাড়ার সংগঠন দিয়ে হবে না। সেখানে ‘এপিক’ নম্বর ধরে তথ্যতালাশের বিষয় রয়েছে। তৃণমূলকে খুঁজে বার করতে হবে, কার এপিক নম্বরে কোথাকার লোকের নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। অর্থাৎ, যেমন পাড়ার সংগঠনকে নামতে হবে, তেমনই সমান্তরাল ভাবে প্রযুক্তিগত কাজও করতে হবে।
তবে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝতে পারছেন, আগামী দিনে তাঁকে তাঁর রাজ্যপাট ছেড়ে যেতে হবে এবং বিজেপির সরকার হবে। সেই জন্য তিনি এজেন্সির কথা বলছেন, ভোটার তালিকায় কারচুপির কথা বলছেন। গোটা ভারত জানে, ভোটার তালিকায় বাংলাদেশি মুসলিমদের নাম ঢোকায় তৃণমূল। কারচুপি করে তৃণমূল। ছাপ্পা ভোটও মারে তৃণমূল। এখন সেই তৃণমূল বলছে, বিজেপি নাকি ভুয়ো ভোটিং করায়! কেউ বিশ্বাস করবেন এ কথা?’’