ব্যাধিটা দীর্ঘদিনের। জানেন মুখ্যমন্ত্রীও। মিলছে না শুধু দাওয়াইটাই!
স্বাস্থ্য দফতরের দায়িত্ব নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কড়া ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, জেলা থেকে শহরে অকারণ রোগী ‘রেফার’ করা বা পাঠানো চলবে না। যদি একান্তই পাঠাতে হয়, তার উপযুক্ত কারণ লিখিত ভাবে জানাতে হবে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে। কিন্তু শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়ে তাঁর সেই পরিকল্পনা।
মঙ্গলবার দিঘায় পূর্ব মেদিনীপুর জেলার প্রশাসনিক বৈঠকে এ কথা স্বীকার করে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘যে-ভাবে হোক, অকারণ রেফার বন্ধ করতেই হবে। জেলা হাসপাতালে পরিকাঠামো বাড়ানো হচ্ছে, অথচ সেখানে ডাক্তারেরা দায়িত্ব নিয়ে কাজ না-করে শহরে রোগী পাঠিয়ে দিচ্ছেন! এটা মোটেই চলতে পারে না।’’
শহরে নির্বিচার রেফার নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেই থামেননি মুখ্যমন্ত্রী। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল থেকে নার্সিংহোমেও আকছার রোগী পাঠানো হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তাঁর নির্দেশ, ‘‘এই অসাধু চক্র যে-করে হোক ভাঙতেই হবে। নইলে সরকারের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে।’’
যখন-তখন কলকাতার যে-কোনও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কিংবা বিধানচন্দ্র রায় শিশু হাসপাতালে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, সাধারণ জ্বর, পেট খারাপ, প্রসব, মামুলি অস্ত্রোপচারের জন্যও রোগীরা সেখানে ভিড় করেছেন। অথচ জেলাতেও যে জটিল রোগের চিকিৎসা এবং অস্ত্রোপচারের পরিকাঠামো তৈরি হয়েছে, সাম্প্রতিক একাধিক ঘটনায় সেটা প্রমাণিত।
তা হলে চিকিৎসকেরা হুটহাট শহরে রোগী পাঠাচ্ছেন কেন?
এক দল চিকিৎসকের ব্যাখ্যা, এটা স্রেফ দায় এড়ানোর চেষ্টা। যে-ডাক্তার সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগীকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন, তিনিই আবার নার্সিংহোমে সেই রোগীর চিকিৎসা করছেন। অর্থাৎ সরকারের কাছ থেকে বেতন নিচ্ছেন, নার্সিংহোমে রোগী রেফার বাবদ কমিশন এবং রোগীর কাছ থেকে চিকিৎসার টাকা পাচ্ছেন। স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা জানান, ডাক্তারদের একাংশ কিছু বেসরকারি ল্যাবরেটরিতে রোগী পাঠিয়ে সেখান থেকে কমিশন পাচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালে আসা রোগীদেরও নার্সিংহোমে রেফার করছেন তাঁরা। ‘‘রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনার কার্ডধারী বহু রোগীকে সরকারি হাসপাতাল থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রেফার করার একাধিক অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। শাস্তিও হয়েছে কিছু চিকিৎসকের। তবু রেফারের রোগ সারছে না,’’ বললেন ওই স্বাস্থ্যকর্তা।
শুধু নির্দেশ জারি করে কিছু হবে না বলে মনে করছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। তাঁদের নিদান, নিয়মিত নজরদারিটা জরুরি। কেন রেফারেল রেজিস্ট্রি তৈরি করা হচ্ছে না, সেই কৈফিয়ত দিতে হবে সব হাসপাতালকেই।
অন্য এক দল চিকিৎসক বলছেন, এ ভাবে বিষয়টা একতরফা দেখা হলে তাঁদের উপরে অবিচার করা হবে। তাঁদের যুক্তি, পরিবর্তনটা এসেছে বহিরঙ্গে। ভিতরের মূল কাঠামোটা একই রয়ে গিয়েছে। যথেষ্ট চিকিৎসক নেই, নেই উন্নত যন্ত্র চালানোর টেকনিশিয়ান বা প্রশিক্ষিত নার্স। অনেক সময়েই চিকিৎসকেরা বুঝতে পারছেন, রোগীকে রেখে দিলে অবস্থার অবনতি অনিবার্য। তাই তাঁরা পত্রপাঠ অন্যত্র রেফার করে দিচ্ছেন।
ডাক্তার সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টরস-এর তরফে গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শুধু পরিকাঠামোই একমাত্র কারণ নয়। এক শ্রেণির ডাক্তারের কাজে অনীহাও এর জন্য দায়ী। আবার ডাক্তার কম আর রোগীর বিপুল চাপ থাকায় অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তারেরা রোগীকে রেফার করতে বাধ্য হন।’’
ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালের এক প্রবীণ চিকিৎসক বলেন, ‘‘আমাদের এখানে নিউরো সার্জারি বিভাগ নেই। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজেও নেই। মস্তিষ্কে চোট নিয়ে কেউ এলে তাঁকে রেফার ছাড়া আর কী করব? ঝাড়গ্রামে কোনও কার্ডিওলজি বিভাগ নেই। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি, পেসমেকার বসানো— কিছুই হয় না।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, এখানে বার্ন ইউনিট নেই, ইউরোলজি বিভাগ নেই। তাই আশপাশের নার্সিংহোমগুলোয় রোগী পাঠাতেই হয়। এতে ডাক্তারের ফায়দা নয়, রোগীর প্রাণটা বাঁচে।
পুরুলিয়া দেবেন মাহাতো সদর হাসপাতালের সুপার শিবাশিস দাস বিষয়টা ভেঙে বলতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, পরিস্থিতির দাবিতে কখনও কখনও রেফার ছাড়া গতি থাকে না। আবার বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজের এক কর্তার কথায়, ‘‘এখানে ইউরো সার্জারি, নেফ্রো সার্জারি কিছু হয় না। সেগুলোর দরকার হলে রোগীকে কলকাতায় রেফার করি।’’ খাতড়া মহকুমা, বিষ্ণুপুর হাসপাতালের মতো একাধিক প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকদের সাফ কথা, ‘‘আমাদের এখানে কোনও পরিকাঠামো না-থাকায় আমরা বাঁকুড়া মেডিক্যালে রেফার করি। বাঁকুড়া সেই চাপ নিতে না-পেরে কলকাতায় রোগী পাঠায়।’’ বর্ধমান মেডিক্যালের এক চিকিৎসক আবার জানাচ্ছেন, কলকাতা থেকে জেলায় যে-সব ডাক্তারকে বদলি করা হয়, তাঁরা বড়জোর দিন দুয়েক জেলায় থাকেন। বাকি সময় থাকেন কলকাতাতেই। তাই রোগীর কোনও দায়িত্ব নিতে চান না তাঁরা।
অর্থাৎ রেফারের মূল কারণ হিসেবে চিকিৎসকদের একাংশ মূলত ঘাটতির কথাই বলছেন। মুখ্যমন্ত্রী কী ভাবে সেই পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করে এবং অন্য কারণগুলোর মোকাবিলা করে রেফার রোখেন, সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy