Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

‘পিতৃভূমি লোকাল’ বানাবই, হুঙ্কার পুরুষ যাত্রীদের

আগের দু’দিন যা ছিল মহিলাদের ‘অধিকার রক্ষা’র লড়াই, সোমবার তারই পাল্টা লড়াইয়ে নামলেন লোকাল ট্রেনের পুরুষ নিত্যযাত্রীরা। মহিলাদের জন্য নির্ধারিত মাতৃভূমি লোকালে পুরুষ যাত্রীদের জন্য কামরা সংরক্ষণের দাবিতে গোলমাল পাকান তাঁরা। সঙ্গে জুটে যায় বহু এলাকার লোকজনও।

উদ্ধার করে আনা হচ্ছে পুলিশকর্মীকে। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

উদ্ধার করে আনা হচ্ছে পুলিশকর্মীকে। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

সীমান্ত মৈত্র
হাবরা শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৫ ০০:৩৬
Share: Save:

আগের দু’দিন যা ছিল মহিলাদের ‘অধিকার রক্ষা’র লড়াই, সোমবার তারই পাল্টা লড়াইয়ে নামলেন লোকাল ট্রেনের পুরুষ নিত্যযাত্রীরা। মহিলাদের জন্য নির্ধারিত মাতৃভূমি লোকালে পুরুষ যাত্রীদের জন্য কামরা সংরক্ষণের দাবিতে গোলমাল পাকান তাঁরা। সঙ্গে জুটে যায় বহু এলাকার লোকজনও।

যার জেরে সোমবার সকাল থেকে দফায় দফায় অবরোধ হয় বনগাঁ-শিয়ালদহ শাখার বিভিন্ন স্টেশনে। মহিলাদের মারধর, গালিগালাজ করা হয়েছে। মাতৃভূমি লোকালে এর আগে গোলমালের ঘটনায় মহিলাদের অধিকারের স্বপক্ষে যাঁদের নাম সংবাদপত্রের পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল, ট্রেনের কামরায় উঠে এ দিন সেই মহিলাদের নাম করে করে খুঁজেছে হামলাকারী পুরুষ যাত্রীরা। উন্মত্ত জনতার হাতে মার খেয়েছেন সাধারণ যাত্রী, এমনকী প্ল্যাটফর্মের আশপাশের দোকানদারেরাও। পুলিশ, সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে উড়ে এসেছে ইট-পাথর। কয়েক জন পুলিশ কর্মী, চিত্র সাংবাদিক জখম হয়েছেন। একের পর এক ভাঙচুর চালানো হয়েছে মাতৃভূমি লোকাল-সহ দু’টি ট্রেনে।

এ দিন গোলমাল রোখার ক্ষেত্রে রেল পুলিশ ও উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের মধ্যে সমন্বয়ের অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন স্টেশনে অবরোধের ছক কষেছেন পুরুষ যাত্রীরা, সেই তথ্যটুকু ছিল না কারও কাছে। মাতৃভূমি লোকালকে কেন্দ্র করে ফের বড়সড় গোলমাল বাধবে না, সেই আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

সোমবার ঘটনার সূত্রপাত সকাল ৭টা ৪০ মিনিট নাগাদ। ৭টা ১৫ মিনিটের মাতৃভূমি লোকাল বনগাঁ ছেড়ে সবেমাত্র পৌঁছেছে গোবরডাঙা স্টেশনে। কিছু পুরুষ যাত্রী তৈরি ছিলেন ট্রেনে ওঠার জন্য। কিন্তু এ দিন প্রতিটি কামরায় আরপিএফ মোতায়েন ছিল। তারা পুরুষ যাত্রীদের উঠতে বারণ করে। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরনোর পরেই গোবরডাঙা স্টেশনে অবরোধ শুরু করেন পুরুষ যাত্রীরা। জোগাড় হয়ে যায় সাদা কাগজ, আলতা। পোস্টার সাঁটানো হয়, যাতে লেখা ‘লেডিজ হঠাও’, ‘মহিলাদের জন্য স্পেশাল ট্রেন তুলে দিতে হবে।’ অবরোধকারীদের অনেককেই এ দিন বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘মাতৃভূমি লোকালকে পিতৃভূমি বানিয়েই ছাড়ব।’’ কৃষ্ণচন্দ্র বারুই নামে এক নিত্যযাত্রীর কথায়, ‘‘মহিলাদের বিক্ষোভের পরে রেল সিদ্ধান্ত নিল, মাতৃভূমি লোকালে শুধু মহিলারাই উঠবেন। আমরাও পাল্টা বিক্ষোভ করে ওই লোকালই তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।’’

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে এসে পড়ে বনগাঁ-মাঝেরহাট লোকাল। অবরোধে আটকে পড়ে সেটি। পথে আরও কিছু স্টেশনে অপেক্ষায় ছিলেন বহু পুরুষ যাত্রী। তাঁরাও আরপিএফের নিষেধ অগ্রাহ্য করে উঠতে পারেননি মাতৃভূমি লোকালে।

সেই খবর ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে হাবরায়। প্ল্যাটফর্মে ঢোকার আগেই আটকে দেওয়া হয় সেটি। আরপিএফ ও জিআরপি কর্তারা এসে পুরুষ যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালাতে থাকেন।

ইতিমধ্যে ১০টা ৪০ মিনিট নাগাদ হাবরায় বাহিনী নিয়ে পৌঁছন ডিএসপি হেড কোয়ার্টার তথা বারাসতের ভারপ্রাপ্ত এসডিপিও দুর্বার বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে ছিল কমব্যাট ফোর্স। লাঠি উঁচিয়ে তাঁরা অবরোধকারীদের দিকে এগিয়ে যান। অবরোধকারীরা প্রাথমিক ভাবে পিছু হঠে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পুলিশ মাতৃভূমি লোকালটিকে হাবরা স্টেশনের ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসে। ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে তখন দাঁড়িয়ে ডাউন শিয়ালদহ-বনগাঁ লোকাল।

পুলিশের ভূমিকায় আগুনে ঘি পড়ে। এতক্ষণের বিশৃঙ্খলা এবং উত্তেজনা মুহূর্তে ফুলেফেঁপে ওঠে। পুরুষ নিত্যযাত্রী ছাড়াও কাতারে কাতারে মানুষ জড়ো হতে থাকেন হাবরা স্টেশনে। রেললাইনের পাথর তুলে পুলিশকে লক্ষ করে ছুড়তে শুরু করে জনতা। পরিস্থিতি নিমেষে আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। ইটের ঘায়ে জখম হন দুর্বারবাবু এবং বনগাঁ জিআরপি-র ওসি লোকনাথ ঘোষ। মাথায় ইট লেগে ফেটে যায় হাবরার এক এসআইয়ের। চোট পান বৈদ্যুতিন মাধ্যমের এক চিত্র সাংবাদিকও । হাবরা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে তো বটেই, আশপাশের এলাকার দোকানপাটও গোলমালের জেরে বন্ধ হয়ে যায়। প্ল্যাটফর্মের সামনে এক ব্যবসায়ী তখনও দোকান বন্ধ করেননি। তাঁর উপরে চড়াও হয় এক দল লোক। মারধর করা হয় ওই যুবককে। কলকাতার হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে তাঁকে।

ততক্ষণে আবার এক দল লোক চড়াও হয়েছে দাঁড়িয়ে থাকা মাতৃভূমি লোকাল ও অন্য লোকাল ট্রেনটিতে। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয় মহিলাদের। প্ল্যাটফর্মেও মহিলাদের দেখে তেড়ে তেড়ে যায় জনতা। অনেকে ট্রেন থেকে নেমে পালান। পালাতে গিয়েও পড়ে গিয়ে চোট পেয়ে জখম হন অনেক মহিলা-পুরুষ। কেউ কেউ ভয়ে ট্রেন থেকে নেমে উঠে পড়েছিলেন ওভারব্রিজে। তাঁদের লক্ষ্য করেও পাথর ছো়ড়া হয়। যে সব মহিলা তখনও ভয়ে নামতে পারেননি মাতৃভূমি লোকাল থেকে, তাঁদের তখন কার্যত মৃত্যুভয় পেয়ে বসেছে। পুরুষ যাত্রীরা দলে দলে উঠে পড়ে একাধিক কামরা। দু’টি ট্রেনেই ভাঙচুর হয়। মহিলাদের কামরায় উঠে শুরু হয় গালিগালাজ, চোটপাট। অনেক মহিলা যাত্রী ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের তলায় আশ্রয় নেন। প্ল্যাটফর্মের দোকানে ঝাঁপ ফেলে আশ্রয় নিতে দেখা যায় পুলিশ কর্মীদের কাউকে কাউকেও। মারমুখী জনতার সামনে কার্যত কোনও প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি পুলিশ।

এ দিকে, বনগাঁ-শিয়ালদহ শাখায় ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উত্তেজনা দানা বাঁধে অন্য কয়েকটি স্টেশনেও। বনগাঁয় যাঁরা টিকিট কেটে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, তাঁরা টিকিটের টাকা ফেরত দেওয়ার দাবিতে কাউন্টারের সামনে গোলমাল পাকান। ভাঙচুরের চেষ্টা হয় কাউন্টারে। কিছুক্ষণের জডন্য কাউন্টারের ঝাঁপ ফেলে দেওয়া হয়।

হাবরায় নিত্যযাত্রীদের গোলমালের প্রতিবাদে অশোকনগরে কিছু নিত্যযাত্রী পাল্টা অবরোধ শুরু করেন। বনগাঁ ও অশোকনগরে রেলপুলিশই পরিস্থিতি তা সামাল দেয়। হাবরায় কিছুক্ষণ বৃষ্টির জন্য অবরোধ তুলেছিলেন বিক্ষোভকারীরা। পরে ফের অবরোধ শুরু হয়। এলাকায় আসেন রেলপুলিশের শিয়ালদহ শাখার সুপার দেবাশিস বেজ, উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায়-সহ পদস্থ কর্তারা। বেলা ২টোর পরে ওই শাখায় রেল চলাচল স্বাভাবিক হয়। দেবাশিসবাবু বলেন, ‘‘এ দিনের গোলমালে কেউ গ্রেফতার হয়নি। আমরা পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছি।’’

এক মহিলা যাত্রীর কথায়, ‘‘এ দিন গোলমালে যাঁরা ছিলেন, যাতায়াতের সুবাদে অনেকেই চেনা মুখ। ধোপদূরস্ত পোশাক-পরিচ্ছদ পরা। অফিস-কাছাড়িতেই যান নিশ্চয়ই সকলে। তাঁরা যে এমন ভাষায় কথা বলতে পারেন, আর এমন মারমুখী হয়ে উঠতে পারেন, ভাবতেই পারছি না। এরপর আর মাতৃভূমি লোকালে ওঠার সাহস পাব কিনা, জানি না!’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE