—প্রতীকী ছবি
ভোট-রাজনীতির ত্রিসীমানায় ‘তিনি’ নেই। তবু তিনি রয়ে গিয়েছেন!
তিনি রয়েছেন ছেলের প্রচারের ‘বীজ মন্ত্রে’। তিনি রয়েছেন ভোটারদের সম্ভ্রমে। তিনি রয়েছেন আলিশান ‘জঙ্গিপুর ভবন’-এর ভিতে। এমনকি, তিনি রয়েছেন প্রতিপক্ষের ‘পদ্ম’ কাঁটার আক্রমণেও!
তিনি, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। পনেরো বছর আগে তাঁকে ভোটে জিতিয়ে প্রথম বার লোকসভায় পাঠিয়েছিল জঙ্গিপুর। তার পরে ২০০৯-এ আরও এক বার। ২০১২ সালে প্রণববাবু লোকসভা ছেড়ে রাইসিনা হিলসের রাষ্ট্রপতি ভবনের বাসিন্দা হওয়ার পরে তাঁর ছেলের ভোট বাক্সে হাত উপুড় করতেও দ্বিধা বোধ করেননি ভোটারেরা। দু’বার ভোটে জিতে এ বারও কংগ্রেসের প্রার্থী প্রণব-পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়।
কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি জঙ্গিপুরে ইতিমধ্যে ভাঙন ধরিয়েছেন তৃণমূল। প্রবীণ কংগ্রেস নেতা মহম্মদ সোহরাবের পথ ধরে তৃণমূলে নাম লিখিয়েছেন আখরুজ্জামান, আশিস মার্জিত, বিকাশ নন্দের মতো জঙ্গিপুর লোকসভায় কংগ্রেসের ভোটযুদ্ধের সেনাপতিরাও।
তবে সে ‘ভয়ে’ কম্পিত নয় অভিজিতের হৃদয়! মাটি কামড়ে লড়তে হলেও তিনি লড়ছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা, কখনও ‘রোড শো’, কখনও সভা করছেন। অনেক সময়ই দুপুরে খাওয়া সারছেন কোনও দলীয় কর্মীর বাড়িতে। এমনই এক দুপুরে তাঁকে ধরা গেল চুয়াপুকুর গ্রামে এক দলীয় কর্মীর বাড়িতে। দুপুরের খাওয়া সেরে বিশ্রামের ফাঁকে ফাঁকে আলাপচারিতায় বোঝা গেল, জঙ্গিপুরের ভোটে বাবার ছায়া অস্বীকার করছেন না ছেলে। এ-ও জানালেন, ভোট, রাজনীতি নিয়ে বাবা আলোচনা না-করলেও ‘উপদেশ’ দিয়েছেন। ‘‘বাবা বলেছেন, যত পারো মানুষের কাছে যাও। সেটা মেনেই প্রচার করছি,’’ স্নিকার্সের ফিতে বাঁধতে বাঁধতে বলছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী।
জঙ্গিপুরে কংগ্রেসে- আরএসএস সংযোগের কথা প্রকাশ্যে বলছেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, গত বছর নাগপুরে আরএসএস-এর সদর দফতরের অনুষ্ঠানে প্রণববাবুর উপস্থিতি এবং সেই ‘ঘনিষ্ঠতা’র জেরেই এখানে কংগ্রেসের হয়ে তলে-তলে কাজ করছে আরএসএস। আরও এক ধাপ এগিয়ে তৃণমূল শিবিরের ইঙ্গিত, বিজেপির এখানে মাফুজা খাতুনকে মনোনয়ন দিয়ে কার্যত কংগ্রেসকে সুবিধা করে দিয়েছে।
কেন? তৃণমূলের শিবিরের ব্যাখ্যা, ভেবেচিন্তেই এখানে সংখ্যালঘু প্রার্থী দিয়েছে বিজেপি। মাফুজা মুর্শিদাবাদের ‘ঘরের মেয়ে’ নন। দক্ষিণ দিনাজপুরের বাসিন্দা মাফুজা ২০০১ ও ২০০৬ সালে দক্ষিণ দিনাজপুরের কুমারগঞ্জের সিপিএম বিধায়ক ছিলেন। বছর দুয়েক আগে দল বদলে বিজেপি আসেন। এখনও প্রচারের ফাঁকে মাঝেমধ্যেই ‘কমরেড’ বলে ফেলেন তিনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, বামেদের ভোটে ভাগ বসাতে পারেন মাফুজা। সামান্য সংখ্যালঘু ভোট কাটলেও তিনি প্রার্থী হওয়ায় সংখ্যাগুরুদের ভোট কংগ্রেসের বাক্সে চলে যেতে পারে। তবে এ সব হিসেব উড়িয়ে নিজস্ব ঢঙেই প্রচার চালাচ্ছেন মাফুজা।
সংখ্যালঘু প্রার্থী অবশ্য তৃণমূলও দিয়েছে। তাদের প্রার্থী, বিড়ি কারখানার মালিক খলিলুর রহমান রাজনীতিতে ‘নবাগত’। গত বিধানসভা ভোটে জঙ্গিপুর কেন্দ্র থেকে জিতে রাজ্যের শ্রম-প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন আর এক বিড়ি কারখানার মালিক জাকির হোসেন। কিন্তু বিড়ি শ্রমিকদের সমস্যা কতটা মিটেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। শোনা যায়, জেলায় শাসক দলের নেতাদের ‘ঐকমত্যের’ অভাব থাকায় নতুন মুখ এনেছেন নেত্রী। কঠিন লড়াইয়ে নেমে দিনভর দৌড়চ্ছেন খলিলুর। আশ্বাস দিচ্ছেন, ভোটে জিতলে লোকসভায় বিড়ি শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে
সরব হবেন।
বিড়ি শ্রমিকের সমস্যাই বামেদের অন্যতম প্রচারের হাতিয়ার। ভোটের পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৬৭ থেকে ২০০৪, এই সময়কালের বেশির ভাগই জঙ্গিপুর বামেদের দখলে ছিল। আসন হাতছাড়া হলেও ভোট এখনও আছে। দেওয়াল লিখন, লাল পতাকার সংখ্যাতেও উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে ভোট প্রচার করছেন সিপিএম প্রার্থী মহম্মদ জুলফিকার আলি। বামেদের আশা, মানুষের সাড়া ইভিএমেও প্রতিফলিত হবে।
এ সব উন্নয়ন, আশ্বাসের কথাতেও ফের ভেসে ওঠেন ‘তিনি’! উন্নয়ন, শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে অভাব-অভিযোগ থাকলেও ঘরোয়া আড্ডায় এক তৃণমূল নেতা মেনে নেন, গত দেড় দশকে জঙ্গিপুরের যতটুকু উন্নয়ন হয়েছে তার অনেকটাই প্রণববাবুর দৌলতে। তবে এ-ও বললেন, ‘‘এটা কিন্তু আমার অফ দ্য রেকর্ড মন্তব্য!’’
বোঝা যাচ্ছে, পদ্মকাঁটা বিঁধুক, না-বিঁধুক, ঘাসফুলের অন্দরেও তাঁর ছায়া মুছে যায়নি। তাই সামনে না-থেকেও ‘তিনি’ই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy