কী চেয়েছি, আর কী পেলাম!
চারিদিকে যা দেখছি, দিনরাত যা শুনতে, বুঝতে বাধ্য হচ্ছি, তা থেকে কেবল এই একটি কথাই মনে হয় বারবার।
সত্যি বলতে কী, এখন আর বুঝেই উঠতে পারি না, কী চাই। ভাবতে ইচ্ছে করে না, কী চাওয়া উচিত। ভাবতে ইচ্ছে করে না, নাকি ভাবতে ভয় হয়? মগজে কার্ফু। হয়তো সেই কারণেই ইদানীং খবরের কাগজ পড়া বন্ধ করে দিয়েছি। দেখি না নিউজ চ্যানেল। পাছে ভয় পেয়ে বসে!
অথচ ছোটবেলা থেকে এই ভয় কিন্তু ছিল না কখনওই। বরং ঠিক উল্টোটাই। একটা আপাদমস্তক রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম। বাবা-কাকারা কাজ করতেন ব্যাঙ্কে। বাম ইউনিয়নের যোদ্ধা। গোটা ছোটবেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাল ঝান্ডা। এখনও কি ব্যাঙ্কের ইউনিয়নে লাল ঝান্ডা আছে? জানি না। কংগ্রেস, তৃণমূল, বিজেপির ঝান্ডাই নিশ্চয় ওড়ে সেখানে! আমার সঙ্গে লাল ঝান্ডার সম্পর্ক ছিল অবশ্য গানে। প্রথম শেখা গান ‘বিদ্রোহ চারিদিকে, বিদ্রোহ আজ’। শিখেছি একের পর এক গণনাট্যের গান। একসঙ্গে চলা, এক সঙ্গে থাকা, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এই সব স্বপ্ন নিয়েই গড়ে উঠেছিল আমার বামপন্থী ছোটবেলা। ভাবতাম, এ-সব ভাবনা সত্যি হবে এক দিন। এ-সব ভাবনায় মিথ্যে নেই কোনও। এ-সব যখন বেশ বিশ্বাসের সঙ্গে ভাবছি এবং বলছি, সেই পর্বেই ব্যাঙ্কে কম্পিউটার ঢোকাতে দেওয়া যাবে না, এই দাবিতে ডালহৌসিতে অনশনে বসেছিলেন বাবা-কাকারা। আর পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে গেল কম্পিউটার। যাতে নিশ্চয় আঁতাঁত ছিল সেই আন্দোলনের কিছু কিছু নেতারও! মোহভঙ্গ হল। বাবা-কাকাদেরও। আমারও।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
কম্পিউটারের সুবিধা এখন আমরা পাচ্ছি। সেই আন্দোলন কতটা ঠিক ছিল, ভুল ছিল কি না, সেই বিচারে যাচ্ছি না। আজ তা নিয়ে আলোচনা করার অর্থও হয় না। কিন্তু আদর্শের যে মোহভঙ্গ হয়েছিল সে-দিন আমাদের মতো অনেকের, সেই ক্ষতটার মেরামত সম্ভবত আর করা যায়নি। হয়তো সেই জন্যই আমার বামপন্থী কাকা আজ সব কিছু ছেড়ে কার্যত গৃহবন্দি। এক সময় যিনি বলতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হলে আত্মহত্যা করবেন, তিনি এখন টেলিভিশনে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতা শোনেন। যখন বলি, উনি কিন্তু প্রধানমন্ত্রীও হতে পারেন। কাকা হাসেন। শুধুই হাসেন।
কলেজে পড়তে পড়তেই পুলিশে চাকরি পেয়েছিলাম। গান গেয়েই যে জীবন কাটিয়ে দেব, সেটা ভাবিনি তখনও। ভাগ্যিস করিনি সেই চাকরি! যদিও আমার বাবা খুব উত্তেজিত ছিলেন আমার চাকরির খবর শুনে। ওঁদের কাছে পুলিশ মানে ‘ন্যায়’। অন্যায়ের প্রতিবাদ। মাঝেমধ্যে মনে হয়, ওদের প্রজন্মের ‘সিস্টেমটাই’ আসলে অন্য রকম ছিল। ‘ন্যায়-অন্যায়’, ‘ঠিক-ভুলে’র একটা স্পষ্ট ধারণা ছিল। যে বাবা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কথা শিখিয়েছেন, শিখিয়ে গিয়েছেন একের পর এক প্রতিবাদের গান, সেই বাবাই কিন্তু সিনেমা হলে গিয়ে স্ক্রিনজোড়া তেরঙার সামনে আমার হাত মুঠি করে চেপে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তখন সিনেমার শেষে জাতীয় সঙ্গীত হত। আমরা দেখতাম গান চলাকালীন একে একে দর্শক বেরিয়ে যাচ্ছেন। বাবার যন্ত্রণা টের পেতাম আমার হাতে।
মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে বোধের সেই ‘সিস্টেম’টাই গুলিয়ে গিয়েছে। সিস্টেম এখন কেবলই ক্ষমতা। কোনও নির্দিষ্ট দলের কথা বলছি না। সার্বিক ভাবে আমাদের বোধ-বিবেচনা রাজনীতির কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। যদি সে দিন পুলিশের চাকরি নিতাম, তা হলে আমিও হয়তো সেই সংকীর্ণ ক্ষমতার বলয়ের অংশ হতাম আজ। হয়ে উঠতাম সিস্টেমের বোরে!
এখনও কি নই? প্রশ্নটা নিজের কাছে নিজের। গান গেয়ে যে স্বাধীন জীবন কাটানোর কথা ভেবে ছিলাম এক দিন। আসলে সেটাও মিথ। ১৯৯৬-’৯৭ সালের বাম আমলে মঞ্চে উঠে যখন গাইতাম ‘হরি হে দীনবন্ধু/ তুমি আমারও বন্ধু বাপেরও বন্ধু/ কখনও ভিখিরি তুমি কখনও ভিআইপি/ ঠান্ডা-গাড়ি চড়ে দেখো গরিবের হাল কী?’ তখন মাঝে মাঝে মনে হতো কার বিরুদ্ধে গাইছি এ গান? যে বামপন্থা এ গান তৈরি করেছে, সে বামপন্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই তো কথাগুলো বলছি! কথাগুলো বলা হচ্ছে তাঁদেরকেও, বাবরি পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনীতিতে যাঁরা গেরুয়া রং লাগিয়ে দিলেন। ক্ষমতা কী ভাবে আদর্শকে গিলে ফেলে তা বুঝতে শুরু করেছি ততদিনে।
এল ‘পরিবর্তনে’র আন্দোলন। আমার কাকার লেখা বামপন্থী গানগুলো আরও প্রাসঙ্গিক হল। আর পরিবর্তনের পরে? মঞ্চে দাঁড়িয়ে যখন গাই ‘রেশনে চাল ছিল/ কম দামে তেল ছিল/ মিঠে মিঠে বাত ছিল/ রাগী রাগী সভা ছিল/ আসলে ভোট ছিল/ তাই ছিল সব ছিল’, দেখি সামনের সারিতে বসে কিছু লোক হাত তালি দিচ্ছেন। তাঁরা নেতা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের। ওঁরা কি বুঝছেন না যে কথাগুলো ওঁদের বিরুদ্ধেই বলা হচ্ছে? বুঝছেন। তবু হাততালি দিয়ে তাঁরা দেখিয়ে দিচ্ছেন, এ সব কথায় তাঁদের কিছু যায় আসে না।
দর্শকদের আসে যায়। রাজনীতির চোরাস্রোত সাধারণ মানুষের মগজে এমন ভাবে ঢুকে বসেছে যে, আজকাল মঞ্চে দাঁড়িয়ে ‘বন্দে মাতরম’ গাইতেও ভয় হয়। মানুষের প্রতিক্রিয়ায় বুঝতে পারি, একেকটা গান কোনও কোনও শব্দের সঙ্গে রাজনীতির অনুষঙ্গ তৈরি হয়ে গিয়েছে তাঁদের। আগে মঞ্চে উঠে গান গাইতে গাইতে কথা বলতাম অনেক। ‘বন্দে মাতরম’ গাওয়ার সময় বলতাম, বাইরের শত্রু নয়, দেশের ভিতরের রাজনীতিই সাধারণ মানুষকে লুঠ করছে। গাইতাম, ‘এ মানচিত্র জ্বলছে জ্বলুক/ এই দাবানল পোড়াক চোখ/ আমার কাছে দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক’, মানুষের প্রতিক্রিয়ায় সমর্থন পেতাম। সার্জিকাল স্ট্রাইকের পর দেখছি, সেই মানুষেরই প্রতিক্রিয়া বদলে গিয়েছে।
ভয় পাচ্ছি। কী চেয়েছি, কী পেয়েছি, সে কথা ভাবার সময় এটা নয়। এ সময় ভয়ের সঙ্গে যুঝে নেওয়ার। যা বলতে চাই, যা ভাবতে চাই, বলা তো দূরের কথা, সেটুকু যদি ভাবতেও না পারি, তা হলে আর সিস্টেমের বাইরে যেতে পারলাম কোথায়? বিশ্বাস করুন, গলা ছেড়ে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘তোমরা বলছ এ গান গেও না/ তোমরা বলছো পথ ছাড়ো/ তোমরাই বেঁধে দিচ্ছ পথ/ এটা নয় ওটা করো/ তোমরা কে হে?’ কিন্তু বলতে পারছি না। কিছু দিন আগেও যত সহজে ‘তোমরা কে হে’ বলার সাহস পেতাম, আজ আর তা পাচ্ছি না। একটা অদৃশ্য বেয়নেটের সামনে দাঁড়িয়ে গান। দাঁড়িয়ে সমাজ। তবু এখনও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, ‘প্রাণ জাগছে জাগছে জাগছে/ ঢেউ উঠছে...’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy