Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

‘শুধু ভোট দিতে গেলেই মনে হয় আমরা ভারতীয়’

আরও কিছু ক্ষণ অনুনয়। তার পরে সব চুপচাপ। ঠা-ঠা রোদে অপেক্ষার প্রহর ফুরোল কয়েক মিনিট পরে। ছাতা মাথায় থলে হাতে আলপথ ধরে এক মহিলা এসে বললেন, “এটুকুই পার করে দিতে পারি। ভোট দিতে গিয়েছিলাম। খাওয়া হয়নি। তেরোঘর যাওয়া হবে না।”

পানি-পথ: ইছামতী নদীর এই অংশ পেরিয়েই পৌঁছতে হয় তেরোঘরে। সোমবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

পানি-পথ: ইছামতী নদীর এই অংশ পেরিয়েই পৌঁছতে হয় তেরোঘরে। সোমবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

নীলোৎপল বিশ্বাস
তেরোঘর শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৯ ০১:১৯
Share: Save:

বাংলাদেশের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে খেলতে ধানিজমির গা বরাবর চলে গিয়েছে সরু রাস্তা। দু’টো ব্রিজ, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তিনটে চেকপোস্ট পেরিয়ে সেই পথও এক জায়গায় শেষ! হাঁটাপথে আরও দু’পা এগিয়ে ইছামতী নদী। সেই পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এক যুবক বললেন, “রিঙ্কা রিঙ্কা বলে চেঁচান। নাম শুনতে পেলে মাঝি ঠিক নিতে আসবেন।” কথা শেষ করেই হাঁটা দিলেন যুবক। ইছামতীর গায়ে ভাসমান চারটি নৌকা ছাড়া দূর-দূরান্তে রিঙ্কার দেখা নেই। তবু হাঁকডাক শুনে নদীর ওপারের তিন-চার ঘরের জনবসতি থেকে আওয়াজ এল, “এখন কেউ নেই। সকলেই ভোট দিতে গিয়েছেন।”

আরও কিছু ক্ষণ অনুনয়। তার পরে সব চুপচাপ। ঠা-ঠা রোদে অপেক্ষার প্রহর ফুরোল কয়েক মিনিট পরে। ছাতা মাথায় থলে হাতে আলপথ ধরে এক মহিলা এসে বললেন, “এটুকুই পার করে দিতে পারি। ভোট দিতে গিয়েছিলাম। খাওয়া হয়নি। তেরোঘর যাওয়া হবে না।” কচুরিপানার বুক চিরে দুলতে থাকা নৌকা ঠেকল অপর পারে। নদীপথ তখনও বাকি। তিন-চার ঘরের এই বসতি ছেড়ে পেরোতে হবে ইছামতীর আরও কিছু্টা অংশ। সুখ-দুঃখের আলাপের মাঝেই মহিলা রাজি হলেন। মায়ের নির্দেশে তেরোঘরের দিকে নৌকা বেয়ে নিয়ে চললেন তাঁর ছেলে। অস্ফুটে সেই ছেলে বললেন, “থাকবে কি কেউ?”

বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের তেরোঘর এলাকা। সোমবার রাজ্যের পঞ্চম দফা ভোটগ্রহণের দিন এই অংশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া ইস্তক শুনতে হয়েছে, ‘‘বাংলাদেশ যাবেন? ওখানে কিছু নেই।” হয়তো সেখানকার

বাসিন্দারাও ভেবে নিয়েছেন, ‘এখানে কিছুই নেই’। ইছামতী যেখানে বাংলাদেশের মাটি ছোঁয়, বনগাঁর সেই অংশে খোপের মতো এক খণ্ড উঁচু জমি। তিন দিকে বাংলাদেশ, সামনে জল। সেই জলের মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে গম্বুজের মতো সাদা পিলার। স্থানীয়েরা ওই পিলার দেখেই ঠাহর করেন, কত দূর পর্যন্ত ভারত আর কোনটা বাংলাদেশ। জলপথে পিলার ঠাহরে তেরোঘরে পৌঁছে জানা গেল, সকলেই ভোট দিতে গিয়েছেন। দেখে অবাক হতে হয় যে, একটা গোটা জনবসতির পাওয়া না পাওয়ার সবেরই ভরসা ইছামতী। রোগে ভুগলে, সংসারে নতুন অতিথি এলে, শিক্ষালাভের প্রয়োজন হলে

ভরসা এই নদীই। দীর্ঘদিন ধরে আবার এখানকার বাসিন্দারাই রাজনৈতিক দলগুলির কাছে ‘ভারতভুক্তি’র দাবি জানিয়ে আসছেন। ভোট এলে রাজনৈতিক দলগুলিও আশ্বাস দেয় যে, এখানকার বাসিন্দাদের আর এই ‘বধ্য-ভূমি’তে পড়ে থাকতে হবে না। তাঁদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে

অন্যত্র। কিন্তু ভোট আসে, ভোট যায়, আশ্বাস পূরণ হয় না। ফাঁকা জনবসতিতে দাঁড়িয়ে মধ্যবয়স্কা শান্তি হালদার বলছিলেন, “আমাদের আর কিছু হবে না। আমরা বুঝে গিয়েছি। এ বার কোনও নেতাই এখানে প্রচার করতে আসেননি। আসবেনই বা কী করে? এত মিথ্যা বলেছেন যে এলেই অপমানিত হতেন।” তবু গ্রাম ফাঁকা করে সকলে ভোট দিতে গেলেন? শান্তির উত্তর, “আমি নিজেও ভোট দিয়ে এসেছি। শুধু ভোট দিতে গেলেই মনে হয় আমরা ভারতীয়।”

যে এলাকায় পানীয় জলের চাপাকল বসেছে শত অনুনয়ে, সেখানকারই ছেলে বিকাশ হালদার বনগাঁ কলেজের কলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তাঁর বাবা-মাও গিয়েছেন ভোট দিতে। তবে তাঁর আক্ষেপ, “আমি তো ভোটটাও দিতে পারি না। জানি না কেন, কোনও বারই আমার নামটা উঠছে না।” কথা শেষ করে বিকাশই ঘুরে দেখালেন তাঁর ‘পাড়া’। তাঁর ঘরের ঠিক পিছনেই জমি দু’ভাগ করে লম্বা বেড়া। সেটাই বাংলাদেশ সীমান্ত। ওপারের মদন সর্দার আর কানাই বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে কিশোর বললেন, “ওরা আমার বন্ধু। ওদের পুলিশ এখানে একটু বেশিই নজরদারি চালায়। তা সত্ত্বেও আমাদের বন্ধুত্ব ভালই চলছে।”

ওপারের আর এপারের আলাপচারিতার মধ্যেই ঘুরে গেলেন দুই বাংলাদেশি বন্দুকধারী। ‘ভারতে ভোট কেমন চলছে?’— তাঁদেরও প্রশ্ন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE