এখন আবেদন করলে বছর পাঁচেক পরে ডাক আসতে পারে এমনটাই জানালেন দক্ষিণ কলকাতার চেতলা অঞ্চলের একটি বৃদ্ধাবাসের মুখ্য আধিকারিক। কলকাতার উপকণ্ঠে আরও একটি বৃদ্ধাবাসের কর্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আবেদনপত্র জমা দিলে কবে নাগাদ একটি ‘সিট’ আশা করা যায়? তাঁর উত্তর, “এক জন মানুষ কবে পৃথিবী ছেড়ে যাবেন, সেটা কী ভাবে বলি বলুন তো? যাঁরা আছেন, জীবদ্দশায় তাঁদের তো আর বাড়ি ফেরা হবে না।” সুভাষগ্রামের একটি বৃদ্ধাবাস সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতি দিন অন্তত সাত থেকে আট জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা তাঁদের পরিজনেরা যোগাযোগ করেন। সকলকেই জানাতে হয়, ‘ঠাঁই নাই’। রাজারহাটের এক বৃদ্ধাবাস-কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, কেউ যোগাযোগ করলে তাঁরা আবেদনপত্র জমা দিয়ে রাখতে বলছেন। কিন্তু কোনও আশ্বাস দেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, সেখানে আবেদনপত্রের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ৭০০ ছাড়িয়েছে!
কলকাতায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের স্থান সঙ্কুলানের সমস্যা এখন বেশ বড় আকার নিয়েছে। কারও বাড়িতে জায়গা নেই, সন্তানেরা দায়িত্ব নেয় না। কারও আবার সন্তান বিদেশে থাকে, শহরে তাঁরা একা থাকার ঝুঁকি নিতে চান না। কেউ নিঃসন্তান, রক্তের জোর কমে যাওয়ার পরে একটা ভরসার হাত খুব প্রয়োজন। এঁদের সকলেরই একটা বিকল্প থাকার জায়গা দরকার। তাই একটা বড় অংশই বেছে নিতে চাইছেন বৃদ্ধাবাসকে। কিন্তু চাহিদা যত রয়েছে, বৃদ্ধাবাসের সংখ্যা তো সেই অনুপাতে নেই। ফলে পরিস্থিতি এমনই যে, বৃদ্ধাবাসে জায়গা পাওয়া এখন লটারি পাওয়ার সামিল হয়ে উঠেছে।
বিভিন্ন বৃদ্ধাবাস ঘুরে জানা গেল, কোথাও পাঁচ লক্ষ, কোথাও বা ছ’লক্ষ টাকা ‘সিকিওরিটি ডিপোজিট’ রাখতে হয়। তার পরেও মাসে ১০-১২ হাজার টাকা করে খরচ। কিন্তু সে সবের ব্যবস্থা করেও একটা থাকার জায়গা জোগাড় করতে পারছেন না বহু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। টালিগঞ্জের একটি বৃদ্ধাবাসের আবাসিক এক অশীতিপর বৃদ্ধা বললেন, “আমরা তো জায়গা খালি করে দিতেই চাই। কিন্তু কবে খালি হবে কেউ জানে না। আমাদের লাস্ট স্টপ এটাই। তবু এটা পেরোতেই অনেকটা সময় লাগে।”
বেশির ভাগ জায়গায় স্বামী-স্ত্রীকে এক সঙ্গে রাখা হয় না। অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আলাদা আলাদা বৃদ্ধাবাসে অন্তিম পরিণতির অপেক্ষা করছেন, শহর জুড়ে এমন নজিরও অজস্র।
সমাজতত্ত্ববিদদের মতে, বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সেই তুলনায় পরিকাঠামো বাড়ছে না। হাসপাতালের শয্যা থেকে শুরু করে বৃদ্ধাবাস-সর্বত্রই এক অভাব। ছেলেমেয়েদের কাজের সূত্রে অন্যত্র থাকার প্রবণতাও বাড়ছে। সর্বত্র বৃদ্ধ বাবা-মা একা হয়ে যাচ্ছেন। তার উপরে বিভিন্ন অপরাধ যে হারে বাড়ছে, তাতে নিঃসন্তান দম্পতিরাও একটা বয়সের পরে শুধু নিজেরা না থেকে কারও উপরে নির্ভর করতে চাইছেন। তাই বহু ক্ষেত্রেই বৃদ্ধাবাসই তাঁদের সমস্যার সমাধান হয়ে উঠছে।
জেরেন্টোলজিস্ট ইন্দ্রাণী চক্রবর্তীর মতে, ছেলেমেয়েরা বাইরে চলে যাচ্ছে। বাবা-মাকে দেখার কেউ নেই। তাই অনেকেই বৃদ্ধাবাসকেই যথাযথ বিকল্প বলে মনে করছেন। তিনি বলেন, “নিখরচার বৃদ্ধাবাসগুলি তো বটেই, ব্যয়বহুল বৃদ্ধাবাসেও ঠাসা ভিড়। একে নিরাপত্তার সমস্যা, তার উপরে বাজার, গ্যাস, ইলেকট্রিক বিল, কলের মিস্ত্রি একা সব সামলাতে না পারার প্রবণতা অনেককে এই বিকল্পের কথা ভাবাচ্ছে। সঙ্গে বাবা-মাকে ব্রাত্য করে দেওয়ার প্রবণতা তো রয়েছেই।”
মানুষের গড় আয়ু বাড়তে থাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের সামাজিক ন্যায় বিভাগ নানা পরিকল্পনা নিয়েছে। ৮০ বছরের বেশি বয়সীদের অঙ্গনওয়ারি প্রকল্পের আওতায় আনা থেকে শুরু করে সন্তান বাবা-মায়ের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকলে আয়করে ছাড় দেওয়ার বিষয়টিও ভাবা হচ্ছে। কিন্তু বয়স্কদের সমস্যার সমাধানের কোনও নির্দিষ্ট নীতি এখনও তৈরি হয়নি। রাজ্যের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা জানিয়েছেন, সরকারি বৃদ্ধাবাস এখন মাত্র একটি। এই সংখ্যাটা বাড়ানো জরুরি। দফতর সূত্রে খবর, সে নিয়েও ভাবনাচিন্তা চলছে। মন্ত্রী বলেন, “বেসরকারি হোমগুলি আমাদের কোনও তথ্য দেয় না। তাই সেখানে কোনও অনিয়ম হলে আমরা ধরতেও পারি না। বহু মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন। এই কারণেই সরকারি বৃদ্ধাবাসের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy