কোলাহলে: সেই পাড়া। নিজস্ব চিত্র
দেশ-বিদেশের ম্যাগাজিন-খবরের সাইটে মাঝেমধ্যেই উঠে আসছে কলকাতা— কিছু কিছু গলির গল্পে!
কলকাতার যে ক’টি জায়গার কথা বলেন ভিন্ দেশিরা, তার অন্যতম এই অঞ্চল। ছোটদের নিয়ে নাটক হোক বা রূপান্তরকামী শিল্পীদের তুলিতে সাজানো বাড়ি— সব খবরই ছড়ায় পৃথিবী জুড়ে। কলকাতার কাছে সে সব গলি যতই হোক না ‘অন্য শহর’।
সোনাগাছি।
ইতিহাস ধরে রেখে, বর্তমানকে বুকে জড়িয়ে এ শহরকে আন্তর্জাতিক প্রাসঙ্গিকতার নতুন পালক উপহার দিয়েছে উত্তর কলকাতার এই অঞ্চল। ফি বছর দেশ-বিদেশের সাংবাদিকেরা এখন ভিড় করেন এখানে। এই এলাকার মহিলা, শিশু, সংস্কৃতি নিয়ে কত গল্প যে মুখে মুখে ঘোরে। পৃথিবী এখানকার অলিগলিকে চেনে এশিয়ার বৃহত্তর যৌনপল্লি হিসেবে। চকচকে কাগজে বড় বড় ফোটো স্টোরি হয় এই এলাকা নিয়ে। আন্তর্জাতিক ফিল্মোৎসবে সম্মানিত হয় এখানকার সংস্কৃতি নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্র।
কলকাতা চর্চায় নিযুক্ত ভিন্ দেশি বহু গবেষক উল্লেখ করে থাকেন, উনিশ শতক নাগাদ ইংরেজদের যত্নেই ফুলেফেঁপে উঠেছে এখানকার বাণিজ্য। তারই সঙ্গে তৈরি হয়েছে একটি সমান্তরাল সংস্কৃতি। তবে তা নিয়ে মতভেদ আছে। ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায়ের বক্তব্য, সোনাগাছিতে ব্যবসা কবে থেকে শুরু হয়েছে, তা বলা সহজ নয়। তাঁর মতে, কলকাতা শহরটাই তো ইংরেজ আমলে বেড়েছে। ফলে এখানকার অনেক কিছুই সে সময়ে বড় হয়েছে। এটুকু বলা যায়, উনিশ শতক থেকেই বেশি করে নজরে পড়তে শুরু করেছে সোনাগাছির সংস্কৃতি।
এক দিকে চিৎপুর রোড, অন্য দিকে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট। অনতিদূরেই উত্তর কলকাতার ভদ্রলোক-বাবুদের পাড়া। সাহেব পাড়াও কাছেই। আর সবচেয়ে কাছে যৌন সাহিত্যের বটতলা। নানা ভাবনার মিশেলে ধীরে ধীরে জমজমাট হয়ে উঠেছিল এই পল্লির বিভিন্ন ঘর। সন্ধ্যা হলেই রঙিন পোশাক, মেক-আপে বাড়ত ব্যস্ততার কোলাহল। নানা সময়ে এই পাড়া থেকেই উঠে এসেছে সংস্কৃতি জগতের বহু বিখ্যাত নাম। গান-বাজনায়, নাটকে— এক সময়ে বাড়ির মহিলাদের আনাগোনার নিয়ম ছিল না সেই জগতে। সে সব ক্ষেত্রে সোনাগাছির মহিলাদের অবদান যৌনপল্লি পেরিয়ে বম্বে পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছে। সাহিত্যেও ধরা পড়েছে সেই সংস্কৃতি। তবে ওইটুকুই। তবে অন্য ধারার সেই সংস্কৃতি যে এক দিন আন্তর্জাতিক মঞ্চে জায়গা করে দেবে, কলকাতার মধ্যে নিজের ছন্দে বেড়ে চলা এই ‘অন্য শহরকে’, তা অবশ্য বোঝেনি এই পাড়া। ওই পল্লিতে যাঁরা যেতেন, তাঁরা ঢুকতেন মুখ আড়াল করে। আর যাঁরা থাকতেন, বাইরের সমাজে তাঁদের জায়গা ছিল না।
এক অর্থে তা এখনও নেই। তবে ধীরে ধীরে কিছুটা হলেও বদলাচ্ছে পরিস্থিতি। গত পঁচিশ-তিরিশ বছরে এই এলাকার মহিলা ও তাঁদের সন্তানদের উন্নতির কাজে এগিয়ে এসেছে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সেই সব সংস্থার মাধ্যমে বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ গাঢ় হচ্ছে এই যৌনপল্লির। ঝাঁ-চকচকে বিলিতি খবরের কাগজে সোনাগাছির ছবি দেখলে নিজের শহরের যৌনপল্লির বাসিন্দাদেরও খানিকটা বুঝি আপন ঠেকে বাইরের সমাজের। যৌনকর্মীদের সন্তানেরা বাইরে বেরিয়ে পড়াশোনা, কাজ করলে অসম্মানের বোঝাও এখন সামান্য কমেছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের নজর যত বেশি পড়েছে, আত্মবিশ্বাস বাড়তেও ততটাই সুবিধে হয়েছে। এখন বাসিন্দারা জানেন, মুখ লুকিয়ে বেঁচে থাকা একমাত্র জীবন নয়।
তবে কি সহজ হয়েছে মেলামেশা? এ তল্লাট আগের মতোই প্রশ্ন তোলে সামাজিক সম্মান নিয়ে। কিন্তু তা তোলে বলেই এখনও এলাকাটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ধরে রাখতে পেরেছে বলে মনে করেন যৌনকর্মী ও তাঁদের সন্তানদের নিয়ে কাজ করা বহু সংগঠনের কর্মী। বাসিন্দারা এখন জানেন, তাঁদের গল্প শুনতেও কিছু কান পাতা আছে।
আমস্টারডামের বিশ্ববিখ্যাত যৌনপল্লির মতো দর্শক টানতে এখনও অভ্যস্ত নয় এ অঞ্চল। নিউ ইয়র্কের যৌনকর্মীদের মতো ব্লগ লেখাও শুরু হয়নি ঘরে ঘরে। তবে নিজেদের অধিকার, স্বাস্থ্য ও সম্মানের দিকে নজর দেওয়া অনেকটাই অভ্যাস করে ফেলেছেন এখানকার মহিলারা। যৌনকর্মী ও তাঁদের সন্তানদের অধিকার নিয়ে কাজ করা দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির মেন্টর ভারতী দে বলছিলেন, প্রায় বারো হাজার মহিলা এখানে কাজ করেন। এঁদের একটা বড় অংশ সরকারি রেজিস্ট্রেশনের জন্য নানা ভাবে লড়ে চলেছেন। কারণ, পল্লিবাসীরা এখন সচেতন— সুনাম না থাকুক, এ বিশ্ব-সমাজের অপরিসীম কৌতূহল আছে তাঁদের নিয়ে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy