ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া রোগীর শরীরের ভিতরে আঘাত লেগেছে মনে করে ‘ফ্লেবোটমি’ বা রক্তক্ষরণ করিয়ে চিকিৎসা শুরু হত আঠারো শতকের কলকাতায়। সে কালের এক নামী সার্জন অ্যাডাম বার্ট ১৭৮৩ সালে নিজের ডায়েরিতে নোট করেছিলেন মৃগি বা খিঁচুনিতেও সেই পদ্ধতিতেই চিকিৎসার কথা। স্কার্ভি থেকে সাধারণ পেটের গন্ডগোলের জন্য ‘অ্যান্টিমনি ওয়াইন’ নামে এক ধরনের মদ্য লিখে দিতেন ডাক্তাররা। বিভিন্ন অসুস্থতার চিকিৎসায় হিং, কর্পূর ছিল মহৌষধ। ম্যালেরিয়া, আমাশা এবং বিশেষত ‘পাক্কা ফিভার’ নামে এক রকম জ্বরের কথা জানা যায়, যার প্রকোপে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রোগীর মৃত্যু হত। শহরের সে কালের একমাত্র হাসপাতাল থেকে খরচ মেটানোর ভয়ে রোগী অনেক সময় পালিয়েও যেতেন, রোগীর নিজস্ব খরচে সব চিকিৎসা হত যে!
এমন যে চিকিৎসার হাল, সেই পরিষেবাও পেতেন শুধু সাহেবরা। সাধারণ ভারতীয়ের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। এদেশীয় মানুষের চিকিৎসার জন্য প্রথম হাসপাতালের ব্যবস্থা ১৭৯২ সালে, কলুটোলায় খোলা হয় প্রথম ‘নেটিভ হসপিটাল’। হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়তে থাকায় তা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় চাঁদনি চক এলাকায়। হসপিটাল স্ট্রিট নামে এখানকার একটি রাস্তা আজও তার সাক্ষী। আরও বড় জায়গার প্রয়োজন হলে সেই হাসপাতালই সরে আসে গঙ্গার ধারে, পরবর্তী কালে যার নাম হয় মেয়ো হাসপাতাল।
এক সঙ্গে প্রচুর মানুষ অসুস্থ হলে নেটিভ হাসপাতাল চাপ সামলাতে পারত না। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে স্বাস্থ্যবিধি জীবনশৈলীর দৃষ্টিকোণ থেকে শহরের জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য পরিষেবায় নতুন আলো ফেললেন জেমস রেনাল্ড মার্টিন। সাধারণ মানুষের উন্নততর চিকিৎসার জন্য একটি আলাদা ‘ফিভার হসপিটাল’-এর প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন এই চিকিৎসক। সরকার গোড়ায় জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আলাদা হাসপাতালের খরচ জোগাতে রাজি হয়নি। কিন্তু মার্টিন ও অন্যান্য চিকিৎসকদের অক্লান্ত চেষ্টায় নতুন ফিভার হাসপাতাল স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলল। ক্রমে মিলল সরকারের সাহায্যও। ১৮৩৫ সালেই স্থাপিত হয়েছিল মেডিক্যাল কলেজ, ১৮৪৮-এ তার পাশেই মতিলাল শীলের দান করা জমিতে নতুন হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন লর্ড ডালহৌসি, নাম হল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বাদ গেল ‘ফিভার’ শব্দটি। ইতিহাসের অদ্ভুত সমাপতন, ২০১০ সালে মেয়ো হাসপাতালও ঘোষিত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস হিসাবে। ৭ এপ্রিল চলে গেল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস, সেই আবহে শহরের জনস্বাস্থ্য-ইতিহাসের এক জরুরি কালপর্বকে ফিরে দেখলে ক্ষতি কী! ছবিতে উনিশ শতকে, ১৮৫০-১৮৭০ সময়ের আলোকচিত্রে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স
১০৮ বাঙালি
চৈতন্যদেবে শুরু, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ে আপাত-শেষ। ইতিহাস বেয়ে বাঙালি প্রতিভার তরণীটির তরতরিয়ে এগিয়ে যাওয়া এখনও চালু, তবে শিল্পীর চোখ তারই মধ্যে খুঁজে নিয়েছে ১০৮ গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি ব্যক্তিত্বকে— ক্যারিকেচার শিল্প-আঙ্গিকে! নতুন বাংলা বছর-শুরুর আবহে বিড়লা অ্যাকাডেমি অব আর্ট অ্যান্ড কালচার-এ শুভেন্দু সরকারের প্রদর্শনী ‘বাঙালি অষ্টোত্তরশতনাম’, ছবিতে ১০৮ বাঙালির গৌরবগাথা। রামমোহন দ্বারকানাথ লালন বিদ্যাসাগর শ্রীরামকৃষ্ণ আছেন, বঙ্কিমচন্দ্র কালীপ্রসন্ন হরপ্রসাদও; রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ অরবিন্দ হয়ে আশুতোষ উপেন্দ্রকিশোর সুকুমার (ছবিতে) নেতাজি জীবনানন্দ মানিক তারাশঙ্কর সত্যজিৎ উত্তমকুমার, সবাই। জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যের পরিকল্পনায় এই প্রদর্শনী ১২-২৪ এপ্রিল। সঙ্গে ১৬ সন্ধ্যায় অন্য ভাবনার সঙ্গীতানুষ্ঠান ‘বঙ্গে-রঙ্গে: রাই-কানু’।

জরুরি সংলাপ
শিক্ষাবিষয়ক দ্বিভাষিক পত্রিকা, তার সূচনা সংখ্যাটিই জাতীয় শিক্ষানীতি ঘিরে। শহরের ‘সিরিয়াস’ পাঠকমহলে উৎসাহী সংলাপ-পরিসর তৈরি করেছে চক সার্কল পত্রিকা (সম্পাদনা: ঋত্বিক মল্লিক)। রয়েছে পিপল’স লিঙ্গুয়িস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া-খ্যাত চিন্তক গণেশ দেবীর সাক্ষাৎকার, জাতীয় শিক্ষানীতির আবহে ‘ক্লাসিক্যাল আর্টস’-এর গুরুত্ব নিয়ে মল্লিকা সারাভাইয়ের ভাবনালেখ্য, এ ছাড়াও নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায় অমিয় দেব সৌরীন ভট্টাচার্য স্থবির দাশগুপ্ত শেখর মুখোপাধ্যায় প্রমুখের লেখা। শিক্ষা ফিরেছে ক্লাসরুমে, কিন্তু মেলেনি বহু প্রশ্নের সমাধান। এই প্রেক্ষাপটে জনপরিসরে জরুরি সংলাপ আরম্ভের কাজটি শুরু করল এ পত্রিকা।
মাইলফলক
সাইকোঅ্যানালিসিস তত্ত্বের প্রবক্তা সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সঙ্গে গিরীন্দ্রশেখর বসুর প্রত্যক্ষ ও মনন-যোগাযোগের কথা আজ সুপরিচিত। সেই যোগাযোগের ফলস্বরূপই বলা যায়, ১৯২২ সালের ২৬ জানুয়ারি তারিখে গিরীন্দ্রশেখর প্রতিষ্ঠা করেন ইন্ডিয়ান সাইকোঅ্যানালিটিক্যাল সোসাইটি (আইপিএস)। শতবর্ষ পূর্ণ করল কলকাতার এই সংস্থা। ভারত সরকারের ডাক বিভাগও শরিক এই গর্বের মাইলফলকের, গতকাল ৮ এপ্রিল কলকাতা সার্কলের পোস্টমাস্টার জেনারেল এই উপলক্ষে প্রকাশ করলেন একটি বিশেষ কভার। দুপুরে ১৪ পার্সিবাগান লেনে সোসাইটির গ্রন্থাগারকক্ষে হল আলোচনাও, ‘ফারদারিং হিউমেননেস’ নিয়ে বললেন বিশিষ্ট সাইকোঅ্যানালিস্ট সুধীর কক্কর, ছিলেন গিরীন্দ্রশেখর ক্লিনিকের ডিরেক্টর অরবিন্দ ব্রহ্ম।
তন্নিষ্ঠ
পঁচানব্বই পেরিয়েছে বয়স, এখনও দৈনন্দিনতার অপরিহার্য অঙ্গ রেওয়াজ। এখনও নিজ সঙ্গীতসৃষ্টিকে আরও পরিশীলিত করে তোলার চেষ্টা, অগণিত ছাত্রছাত্রীদের পথ দেখিয়ে দেওয়া। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কণ্ঠসঙ্গীত বিভাগের সঙ্গে শুরু থেকেই জড়িয়ে পণ্ডিত অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, তিন দশকেরও বেশি সময় সঙ্গীতের পাঠ দিয়েছেন সেখানে। বিষ্ণুপুর ঘরানার বিশিষ্ট মার্গসঙ্গীতগুণী, খেয়ালে লব্ধপ্রতিষ্ঠ এই শিল্পীকে নিয়ে মৃন্ময় নন্দীর তথ্যচিত্র চরৈবেতি দেখানো হল গত ৬ এপ্রিল, নন্দন-৩’এ। নন্দিনী চক্রবর্তীর উদ্যোগে তৈরি ছবিটির প্রদর্শনে উপস্থিত ছিলেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, পণ্ডিত কুমার বসু, পণ্ডিত স্বপন সাহা, পণ্ডিত তন্ময় বসু, পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার, গৌতম ঘোষ, শ্রীকান্ত আচার্য-সহ বিশিষ্টজন।
নতুন দিগন্ত
আমেরিকান ছোটগল্পকার ও হেনরি-র স্মৃতিতে তাঁর বন্ধুদের শুরু করা ‘ও হেনরি প্রাইজ়’ পেলেন অমর মিত্র, তাঁর গাঁওবুড়ো গল্পের ইংরেজি অনুবাদের জন্য। ১৯১৯-এ শুরু হয়েছে এই পুরস্কার, উইলিয়াম ফকনার, অ্যালিস মুনরো, সল বেলো, জন আপডাইক-এর মতো লেখকেরা সম্মানিত আগে, এ বছর বাঙালি লেখকের সহ-পুরস্কারপ্রাপক ২০১৮ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী ওলগা তোকারচুক-ও— এই সব তথ্যই খুব সুখদ। এক কালে না-আমেরিকান লেখকেরা বাদ যেতেন পুরস্কারের নির্বাচন থেকে, ক্রমে একটু একটু করে দোর খুলেছে অন্য দেশ অন্য ভাষার ছোটগল্পকারদের জন্য। এ বছর গ্রিক, হিব্রু, নরওয়েজিয়ান, পোলিশ, রাশিয়ান, স্প্যানিশের পাশে সগৌরব ঠাঁই বাংলারও, অমর মিত্র ও অনুবাদক অনীশ গুপ্তের হাত ধরে।

স্মৃতি ও কথা
‘ও হ্যাঁ শংকর-এর জন অরণ্য উপন্যাসটা পড়ে ফেলো, ওখানে সোমনাথ অর্থাৎ হিরো চরিত্রটার কথা আমি তোমার জন্য ভেবে রেখেছি।’ “কথাক’টি অত্যন্ত নিচু গলায় বলেই আমার অবাক হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন সুন্দর করে আশ্বাসের হাসি হাসলেন সত্যজিৎ রায়...” প্রদীপ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন। সপ্তর্ষি থেকে প্রকাশিত তাঁর জন অরণ্যে বইটিতে শুধু সত্যজিতের ছবিতে ‘হিরো’ হওয়ার দিনগুলিই নেই, “আমার দেখা অভিনয়ের জগৎ এবং আইনের জগৎই আমার লেখার বিষয়। সততার সঙ্গে ধরতে চেষ্টা করেছি...”, জানিয়েছেন কথামুখে। গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধ, বাঙালি জীবনের নানা ওঠাপড়াকে আত্মযাপনের সঙ্গে মিশিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন সময়ের জলছবি। শিল্পনিষ্ঠ মিতবাক মানুষটি আড়ালেই বরাবর, অথচ সত্যজিতের কৃতী নায়কদের এক জন তিনি, ঠিকানা এখনও এই শহর। বইটি সত্যজিৎ-শতবর্ষে উত্তর-প্রজন্মের কাছে চমৎকার এক উপহার। ছবিতে জন অরণ্য-র শুটিংয়ে প্রদীপ মুখোপাধ্যায় ও সত্যজিৎ রায়— সন্দীপ রায়ের ক্যামেরায়।
নৃত্যে গানে
‘নৃত্যকলা যেন চিত্রে লিখা’, রবীন্দ্র-শব্দগুচ্ছকে সার্থক করেছেন পলি গুহ-সাধন গুহ জুটি, কয়েক দশক ধরে। মুসাফির, কালিদাস ও মালিনী, জগন্নাথ, রবীন্দ্রনাথের নানা নৃত্যনাট্যে (ছবিতে শ্যামা-য় ওঁরা) তাঁদের পরিবেশনা এখনও মনে রেখেছে কলকাতা। সাধন অকালপ্রয়াত, পলি গুহর নেতৃত্বে ‘ইন্ডিয়ান কালচারাল ট্রুপ’-এর পথ চলা থামেনি। তাঁর পঁচাত্তরতম জন্মদিন উপলক্ষে আজ বিকেল সাড়ে ৫টায় রবীন্দ্রসদনে শ্যামা নৃত্যনাট্যে নামভূমিকায় পলি, সঙ্গী এ কালের কুশলী শিল্পীরা। দেখানো হবে পলি গুহকে নিয়ে তথ্যচিত্রও। অন্য দিকে, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও শিক্ষক অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গীত-প্রতিষ্ঠান ‘অভিজ্ঞান’ বছরভর নানা আয়োজনে বিশেষ গুরুত্ব দেয় গানের ঔপপত্তিক দিকটিকে। তারই অঙ্গ হিসাবে আজ ও কাল, ৯-১০ এপ্রিল সকাল ১১টা থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রিগুণা সেন প্রেক্ষাগৃহে দিনভর আলোচনা ‘প্রাণের টানে, কথায় গানে’। বলবেন মনোজ মিত্র পবিত্র সরকার ঊষা উত্থুপ অলক রায়চৌধুরী সুস্মিতা গোস্বামী, অগ্নিভ নিজেও। মুম্বইয়ের ‘এবং দেবব্রত’ সংস্থার উদ্যোগে আগামী কাল রোটারি সদনে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অনুষ্ঠান ‘একমাত্র দেবব্রত’, শিল্পীকে নিয়ে বলবেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, অলক রায়চৌধুরী গান গাইবেন দ্বিতীয় পর্বে।

শুধু বই
শেষ হইয়াও হইল না শেষ! সেন্ট্রাল পার্কে বইমেলা ফুরিয়েছে তো কী, ফিরে এসেছে একেবারে বইপাড়ায়, বিদ্যাসাগর উদ্যান তথা কলেজ স্কোয়ারে। ৮-১৬ এপ্রিল প্রতিদিন দুপুর ১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সেখানেই ‘বইমেলা ও সাহিত্য উৎসব’, পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের উদ্যোগে, বঙ্গীয় প্রকাশক ও পুস্তকবিক্রেতা সভার আয়োজনে। আবার কলেজ স্ট্রিটেই বেশ ক’টি বই-বিপণি এবং প্রকাশকেরা আলাদা করে খুলে দিয়েছেন ‘চৈত্র বইবাজার’, দেখেশুনে নানা ছাড়ে বই কেনার সুযোগ সেখানেও। এ বার বইয়েই বর্ষশেষ বাঙালির, বইয়েই নববর্ষ।