অপেক্ষা: (বাঁ দিকে) এসএসকেএম হাসপাতালে মানিক রায়।
দশ দিন হয়ে গিয়েছে। এসএসকেএম হাসপাতালের বার্ন ইউনিট চত্বর ছেড়ে বাড়ি ফেরা হয়নি উল্টোডাঙার মানিক রায়ের। ওই বার্ন ইউনিটেই গত শুক্রবার মারা গিয়েছে তাঁর সাড়ে ছ’মাসের ভাইঝি ঈশিকা রায়। এখনও ওই ইউনিটেই অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় ভর্তি তাঁর ভাই মধুসূদন এবং ভ্রাতৃবধূ মাম্পি। বাড়ি না ফিরলেও গত শুক্রবার এক বার হাসপাতাল থেকে বেরোতে হয়েছিল মানিককে। বাবা-মা ভর্তি থাকায় তাঁকেই শেষকৃত্য করতে হয় অগ্নিদগ্ধ ভাইঝির!
এই ধরনের পরপর কয়েকটি ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে স্বাস্থ্য ভবন। হাসপাতালগুলির জন্য কোনও মতে রোগী না ফেরানোর নির্দেশিকা নতুন করে জারি করা হয়েছে শুনে মঙ্গলবার মানিক বলেন, ‘‘আমাদের পরিবারটাই তো শেষ হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তারবাবুদের কাছে অনুরোধ, আমার ভাই আর ভাইয়ের বৌকে অন্তত বাঁচিয়ে দিন। আমাদের মতো যেন আর কারও সঙ্গে এমন না হয়। কাউকে যেন এ ভাবে হন্যে হয়ে ঘুরতে না হয়...!’’ কথা শেষ করতে পারেন না, গলা বুজে আসে মানিকের।
গত ৩০ মার্চ রাতে ঘুমের মধ্যেই অগ্নিদগ্ধ হয় মানিকদের পরিবার। ওই অবস্থাতেই রাত তিনটে থেকে পরের দিন সকাল আটটা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটে বেড়াতে হয় মানিকদের। বি সি রায় শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও সঙ্গে মা না থাকায় ঈশিকাকে ভর্তি নিতে চাওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। শিশুর মা-ও যে অগ্নিদগ্ধ, সে কথা জানানোর পরেও লাভ হয়নি! এর পরে তাকে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা করা হলেও শয্যা না থাকায় একরত্তি শিশুটিকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এর পরে ঈশিকাকে নিয়ে যাওয়া হয় নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেও শয্যা নেই বলে দেওয়ার পরে ৩১ মার্চ সকালে এসএসকেএম হাসপাতালে ঈশিকাকে ভর্তি করাতে পারেন মানিকেরা। একই অবস্থা হয় ঈশিকার বাবা মধুসূদন ও মা মাম্পির। একটি সরকারি এবং দু’টি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে এক দিন পরে তাঁদের ঠাঁই হয় এসএসকেএমে।
এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই অনেকের মনে পড়ে যায় গত মার্চের শুরুতে গোবরডাঙা থেকে শহরে চিকিৎসা করাতে আসা দিয়া দাস নামে সাড়ে পাঁচ বছরের এক অগ্নিদগ্ধ শিশুর কথা। দিয়াকে নিয়ে ছ’টি হাসপাতালে ঘুরতে হয়েছিল তার পরিবারকে। শেষে অবস্থান বিক্ষোভের জেরে দিয়াকে ভর্তি নেয় আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। সেখানেই পাঁচ দিনের মাথায় মৃত্যু হয় দিয়ার। পরিবারের অভিযোগ ছিল, হাসপাতালগুলি ভর্তি নিতে চায়নি। সময়ে ভর্তি নিলে মেয়েটা হয়তো আর একটু বেশি দিন বাঁচত।
ঈশিকা রায়। দিয়া দাস (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র
দিয়ার বাবা বাপি প্যান্ডেল বাঁধার কাজ করেন। মা চায়না দাস গৃহবধূ। গত মার্চে একটি নতুন ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন তাঁরা। সেখানেই গৃহপ্রবেশের দিন ঘরে জ্বালানো মোমবাতি থেকে আগুন লাগে দিয়ার গায়ে। মেয়ের মৃত্যুর পরে ওই ঘরে মন টিকছে না মায়ের। আত্মীয়দের বাড়ি ঘুরে ঘুরে থাকছেন তিনি। মঙ্গলবার ফোনে বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য ভবন অনেক কিছু বলেছে শুনলাম। এটা কেন আগে বলেনি? তা হলে আমার মেয়েটাকে মরতে হত না।’’ এমন নির্দেশ অবশ্য স্বাস্থ্য ভবন আগেও জারি করেছিল। চায়না এ বার ক্ষোভে ফেটে পড়ে বলেন, ‘‘আগেও তা হলে কাজ হয়নি! হাসপাতালগুলো এর পরেও নির্দেশিকা না মানলে কী শাস্তি হবে, সেটা কেন বলছেন না স্বাস্থ্যকর্তারা? আমরা ঈশিকার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। প্রয়োজনে একসঙ্গে আইনি লড়াই লড়ব।’’ আর দিয়ার বাবা বাপি বলছেন, ‘‘হাসপাতালগুলো একটু মানবিক হোক।’’
এ ব্যাপারে কথা বলতে বারবার ফোন করা হলেও ধরেননি রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র। তবে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘এত চাপ তো। তাই কিছু ক্ষেত্রে রিফিউজাল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রিফিউজালটাও যাতে মানবিক হয়, সেটা দেখতে হবে।’’ হাসপাতাল এর পরেও ফিরিয়ে দিলে কী ব্যবস্থা হবে? সেই প্রশ্নের অবশ্য উত্তর মেলেনি অজয়বাবুর কাছে।
প্রসঙ্গত, আজ বুধবার ঈশিকার পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে পারেন স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকেরা। তাঁদের অভিযোগ শুনে স্বাস্থ্য ভবন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে বলে জানাচ্ছেন এক স্বাস্থ্যকর্তা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy