Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

জয় করেও ‘কাঁটা’র খোঁচায় আহত তৃণমূল

পদ্মে কাঁটা থাকে। কিন্তু জোড়া ঘাস ফুলেও যে কাঁটা থাকে, টের পেলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। কলকাতা পুরসভায় গতবারের চেয়ে এ বার তৃণমূলের আসন এবং ভোটের হার দুই-ই বেড়েছে। ১৪৪টি ওয়ার্ডে সব বিরোধী মিলে পেয়েছে সাকুল্যে ৩০টি আসন। কিন্তু উত্তর থেকে দক্ষিণে তৃণমূলের একাধিপত্যেও বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব ‘কাঁটা’ ফুটিয়েছে।

নির্দল প্রার্থী হিসেবেই জয়ী হলেন ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতা। তাঁর বিজয় মিছিলে রইল তৃণমূলের দলীয় পতাকাও। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

নির্দল প্রার্থী হিসেবেই জয়ী হলেন ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতা। তাঁর বিজয় মিছিলে রইল তৃণমূলের দলীয় পতাকাও। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

সঞ্জয় সিংহ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২৭
Share: Save:

পদ্মে কাঁটা থাকে। কিন্তু জোড়া ঘাস ফুলেও যে কাঁটা থাকে, টের পেলেন তৃণমূল নেতৃত্ব।

কলকাতা পুরসভায় গতবারের চেয়ে এ বার তৃণমূলের আসন এবং ভোটের হার দুই-ই বেড়েছে। ১৪৪টি ওয়ার্ডে সব বিরোধী মিলে পেয়েছে সাকুল্যে ৩০টি আসন। কিন্তু উত্তর থেকে দক্ষিণে তৃণমূলের একাধিপত্যেও বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব ‘কাঁটা’ ফুটিয়েছে। উত্তরের ৭, ১০, ১৭ নম্বর ওয়ার্ড থেকে দক্ষিণে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খাস তালুক ভবানীপুরের ৭০ নম্বর ওয়ার্ড— হাত ছাড়া হয়েছে জোড়াফুলের ‘কাঁটা’তেই! গতবারের থেকে এ বার দলের আসন বাড়ায় নেতৃত্ব সন্তুষ্ট। প্রকাশ্যে তাঁরা কেউই কাঁটার জ্বালা স্বীকার করছেন না। কিন্তু দলের অন্দরে, বিশেষত যে ওয়ার্ডে কাঁটার ঘায়ে দলীয় প্রার্থী ঘায়েল, সেখানে কর্মীরা সরাসরি অন্তর্ঘাতের অভিযোগ তুলেছেন।

উত্তরের ৭ নন্বর ওয়ার্ডে বিজেপির নতুন প্রার্থী বাপি ঘোষের কাছে হেরেছেন তৃণমূলের মঞ্জুশ্রী চৌধুরী। বিদায়ী পুরবোর্ডেও তিনি কাউন্সিলর ছিলেন। বাপি একদা তৃণমূলে ছিলেন। ভোটের আগে যোগ দেন বিজেপিতে। হারের পরে ওই ওয়ার্ডে তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভাপতি এবং মঞ্জুশ্রী দেবীর ছেলে অভিজিৎ (বাপ্পা) চৌধুরীর অভিযোগ, ‘‘তৃণমূলের অন্তর্ঘাতেই আমাদের প্রার্থী হেরেছেন!’’ অন্তর্ঘাতের জন্য বাপ্পা দায়ী করেন মন্ত্রী সাধন পাণ্ডের অনুগামীদের। সাধনবাবু এই অভিযোগ নিয়ে অবশ্য মন্তব্য করতে চাননি। এলাকায় সাধন-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত তৃণমূল ছাত্র পরিষদের উত্তর কলকাতার সভাপতি পুষ্পক সাহার অভিযোগ, ‘‘এখানে হারের কারণ, সিপিএম থেকে আসা নব্য তৃণমূলীদের দিয়ে আমাদের মতো পুরনো তৃণমূল কর্মীদের দূরে সরিয়ে দেওয়া। এলাকার মানুষ তার জবাব দিয়েছেন।’’ পাশের ১০ নম্বর ওয়ার্ডে গতবার জেতেন সিপিআইয়ের করুণা সেনগুপ্ত। এ বারও তিনি তৃণমূলের প্রসূন ঘোষকে হারিয়েছেন। এর পিছনেও অন্তর্ঘাতকে দায়ী করেছেন এলাকার তৃণমূলের একাংশ। প্রসূন এলাকার বিধায়ক ও মন্ত্রী শশী পাঁজার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। তিনি এলাকার বাসিন্দা নন বলে তাঁকে প্রার্থী করার সময় থেকে দলের অন্য অংশ আপত্তি তুলেছিল। তাঁরাই ভোটে অন্তর্ঘাত করেছে বলে অভিযোগ।

উত্তর কলকাতার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে মেয়র পারিষদ পার্থপ্রতিম হাজারি এ বারও প্রার্থী হন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে দলের ‘বিক্ষুব্ধ’ নেতা মোহন (মনা) গুপ্ত নির্দল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। পার্থ বনাম মনার লড়াইয়ে দু’পক্ষে ছিলেন দুই মন্ত্রী। বিষয়টা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে দলের রাজ্য নেতৃত্বকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। মনাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে তৃণমূল ঘোষণাও করে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। পার্থবাবুকে হারিয়ে দিয়েছেন মনা! ফল বেরোনোর পরে পার্থ-অনুগামীরা দলের এক মন্ত্রী এবং এক মেয়র পারিষদের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। আক্ষেপ, বাধা দিয়েছে দলেরই অন্য গোষ্ঠী। তবে মনার কথায়, ‘‘আমার জয় মা-মাটি-মানুষের জয়। দল আমাকে ফিরিয়ে নিলে ফিরে যাব। দিদিই আমার নেত্রী।’’ বিক্ষুব্ধ প্রার্থীরা তৃণমূলের ‘অফিসিয়াল’ প্রার্থীদের হারিয়ে দিলে তাঁদের দলে ফিরিয়ে নেওয়ার জল্পনা ছিলই। মঙ্গলবার থেকেই সে ইঙ্গিত মিলতে শুরু করেছে। মনা যেমন দিদিকে নেত্রী বলে মেনেছেন। একই ভাবে বন্দর এলাকায় তৃণমূল প্রার্থী হেমা রামকে হারানোর অব্যবহিত পরেই আরেক বিক্ষুব্ধ আনোয়ার খান কালীঘাটে দলনেত্রীর বাড়ি গিয়ে মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের উপস্থিতিতে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে প্রণাম করে দলে ফিরেছেন! অন্তর্দ্বন্দ্বের কাঁটায় দলের ধাক্কা খাওয়া নিয়ে এ দিন তৃণমূল নেত্রীও বলেছেন, ‘‘মোটেই ফল খারাপ হয়নি। যাঁরা যাঁরা ওখানে জিতেছেন তাঁরা সব নির্দল। ওখানে অন্য অঙ্ক ছিল।’’

দক্ষিণে অন্তর্দ্বন্দ্বের আঁচ লেগেছে মমতার খাসতালুক ৭০ নম্বর ওয়ার্ডেও। লোকসভা ভোটের সময় থেকেই এখানে বিজেপির রমরমা শুরু হয়। তাতে শিক্ষা নেওয়া দূরের কথা, উল্টে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই প্রকট হয় তৃণমূলে। ফলে বিদায়ী পুরবোর্ডের চেয়ারম্যান সচ্চিদানন্দ (মনুয়া) বন্দ্যোপাধ্যায় হেরেছেন বিজেপির অসীম বসুর কাছে। সচ্চিদানন্দবাবু হারের জন্য কাউকে দোষারোপ করেননি। তাঁর ঘনিষ্ঠদের অভিযোগ, পরাজয়ের কারণ ১০০% অন্তর্ঘাত। কিন্তু ভবানীপুরে ফল ভাল হয়েছে বলেই অভিমত মমতার।

যে সব ওয়ার্ডে ফল খারাপ হয়েছে, তা নিয়ে এ দিন বিশ্লেষণে যেতে চাননি তৃণমূল নেতৃত্ব। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, ‘‘তৃণমূলের ভোটও বেড়েছে, আসনও বেড়েছে। যে সমস্ত জায়গায় আমাদের প্রার্থীরা হেরেছেন, তা কেন হল, তা পর্যালোচনা করে দেখতে হবে।’’ তিনি জানান, বেহালার ১২৭ এবং ১২৮ নম্বর ওয়ার্ডে দলের প্রার্থীদের হারের কারণ সাংগঠনিক দুর্বলতা। তাঁর কথায়, ‘‘দলীয় সংগঠন এবং পরিষেবা দেওয়ার ব্যাপারে যতটা তৎপরতা দেখানো উচিত ছিল, তা হয়তো হয়নি।’’ পার্থবাবুরা প্রকাশ্যে এ কথা বললেও বেহালার মতো তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটিতে বিরোধীদের দু’টি আসন পাওয়াকে স্বাভাবিক বলে মনে করছেন না শাসক দলের একাংশই। বর্ষীয়ান নেতা ও মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রাজনীতি হল ক্ষমতা দখলের লড়াই। সেখানে একটু-আধটু অন্তর্ঘাতের মতো ঘটনা থাকবেই। ১৯৮২ সালে ইন্দিরা গাঁধী আমাকে জোড়াবাগানে প্রার্থী করেছিলেন। তখন ইলা রায় নির্দল হয়ে দাঁড়ান। এ সব হয়েই থাকে।’’

২৯ নম্বর ওয়ার্ডে পরেশ পাল বা ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডে ডেপুটি মেয়র ফরজানা আলমের হেরে যাওয়ায় দলের নেতাদের অনেকেই অন্য বিপদের গন্ধ পাচ্ছেন। একদা তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষের ঘনিষ্ঠ ফারজানা গতবার ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী হয়ে জিতেছিলেন। এ বার তাঁকে ৬৫ নম্বরে সরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি জিততে পারেননি। পরে কালীঘাটে গিয়ে তাঁকে কাঁদতেও দেখা গিয়েছে। ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে কংগ্রেস প্রার্থী প্রকাশ উপাধ্যায়ের কাছে হেরেছেন পরেশ পাল। পাথর্বাবু এই দুই হার প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘বিরোধীরা তো রিগিং-সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলেছেন। রিগিং হলে কি ওঁরা হারেন?’’ কিন্তু দলের নেতাদের একাংশের বক্তব্য, মুসলিম ভোট পক্ষে ছিল না বলেই এই ফল। তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের অনেকেই কবুল করেন, মুসলিম ভোটের ১০০% তাঁদের সঙ্গে নেই। ফিরহাদ হাকিম, অরূপ বিশ্বাসের এলাকার অনেক ওয়ার্ডে দলের খারাপ ফলও তাঁদের চিন্তায় ফেলেছে।

আগামী বিধানসভা ভোটের আগে ফুলের কাঁটা বেছে না ফেললে আরও বড় বিপদ দলের সামনে আসবে বলে আশঙ্কা ওই নেতাদের।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE