এক রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা জরুরি বৈঠকে বসেছেন। দলের এক তরুণ নেতার ভবিষ্যৎ নিয়ে ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা। ঘণ্টা দেড়েকের রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পরে বেরিয়ে এসে প্রথম সারির এক রাজ্যনেতা আর এক নেতাকে বললেন, ‘‘কী মত দেব জানতে তোমাকে এতবার মেসেজ করছি! আর তুমি শুধু চোখ উল্টোনো ইমোজি পাঠাচ্ছো?’’ জবাবে অন্য নেতা বলেন, ‘‘ওটাই তো জবাব! বুঝে নিতে হয়।’’
সে যাত্রায় ‘বুঝে নেওয়া’ গিয়েছিল কি না, তা অবশ্য খোলসা করেননি দুই নেতার কেউই। শুধু এক জন হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘‘এরকম দ্বিতীয় দিন করলে বৈঠকে স্মাইলি এঁকে, কাগজ তুলে ধরে উত্তর দেব। বুঝবে ঠেলা। তখন তোমরাও বুঝে নিও!’’
মঙ্গলবার বিশ্ব ইমোজি দিবসে ‘ইমোটিকন কথোপকথন’-এর এই ‘বুঝে নেওয়া’ নিয়েই জোর চর্চা শুরু হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এই বুঝে নিতে গিয়েই ভুল বোঝার ঘটনা ঘটছে প্রচুর। কেউ এক কথা বলতে চাইছেন অন্যেরা বুঝছেন আর এক। এতে বার্তা প্রেরক এবং গ্রাহকের মধ্যে দূরত্ব বা়ড়তে বাধ্য। কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, চটজলদি উত্তর দিতে বা আসল উত্তর লুকোতে ‘ইমোটিকন’-এর ব্যবহার আসলে এক ধরনের এড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতার জন্ম দিচ্ছে। এটি চলতে থাকলে মানুষ কথা হারাবে। ‘কনফিউজড’ ইমোজি-র প্রসঙ্গ তুলে কেউ কেউ বলছেন, ‘‘এক চিহ্নের অনেক অর্থ হতে পারে। কে কোনটা ধরবেন, তা তো বোঝাই যাচ্ছে না।’’ ইমোজি সমর্থকদের অবশ্য দাবি, ইমোজি ছাড়া কথোপকথন এখন ভাবাই যায় না। বুঝে নেওয়াটাও তো কখনও কখনও জরুরি!
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এক একটি ইমোজির অর্থ এক এক রকমের হতে পারে। অনেকেই মনে করেন, বহুল ব্যবহৃত ‘জোড় হাত’ ইমোজিটি প্রার্থনা, হাততালি বা ‘হাই ফাইভ’ বোঝায়। ইমোজি বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, ওটি আদতে জাপানি সংস্কৃতি অনুযায়ী ধন্যবাদ বোঝায়। দু’হাত খোলা, হাস্যমুখের ‘হাগিং ফেস’ ইমোজিটি অনেকে সম্ভাষণ জানানোর কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেন। কিন্তু, আদতে তা জড়িয়ে ধরা বা ‘হাগ’-এর ইমোজি। দু’হাতে সামনে ঝুঁকে পড়া ‘পার্সন বাওয়িং’-এর ইমোজিকে বহু মানুষ মনে করেন, মাথা নিচু করে, সামনে ঝুঁকে বিশ্রামের কিংবা মেঝেয় শুয়ে ব্যায়ামের প্রতীক। কিন্তু আদতে তা কাউকে অভিবাদন জানাতে ব্যবহার করা উচিত। ২০১৫ সালে আবার বর্ণবিদ্বেষ ছড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই ইমোজি। মুখের একাধিক ইমোটিকন তখন ছিল হলদে রঙের। পরবর্তী সময়ে সেই সমস্যা কাটাতে নানা রঙের ইমোটিকন তৈরি শুরু করে মোবাইল অপারেটিং সংস্থাগুলি।
সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র বলছেন, ‘‘ইমোটিকন ব্যবহার করে কথা বলা আসলে স্ট্র্যাটেজি ল্যাঙ্গুয়েজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইমোজি ব্যবহার করে কথা বলে কেউ নিজেকে যতটা ওপেন করছেন, ততটা গোপনও রাখছেন। তাই বিভ্রান্তি ছড়াতে বাধ্য।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘এই গিমিক কমিউনিকেশনের জেরে সামাজিক সম্পর্কগুলোও গিমিক হয়ে যাচ্ছে।’’ মনোবিদ রিমা মুখোপাধ্যায়ের মত, ‘‘আবেগ চেপে রাখার এক অসাধারণ অস্ত্র পেয়েছে মানুষ। কিন্তু এ ভাবে আবেগ চেপে রেখে আমরা কোন পথে চলেছি, তা-ও ভাবা প্রয়োজন।’’ তাঁর দাবি, কথা বলা আর না বলার মাঝের এই পর্যায়ে আটকে যাচ্ছে আবেগ। পরবর্তীকালে অন্য ভাবে এই আবেগের বর্হিপ্রকাশ ঘটবে।
সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলছেন, ‘‘ইমোজি এখন আর নতুন নয়। ইমোজি জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে। আগে বার্তা বিনিময়ের ক্ষেত্রে ইমোজির ব্যবহার এক অন্য মাত্রা যোগ করত। কিছু না বলেও অনেক কথা বলা যেত। কিন্তু এখন ইমোজি আর তা পারছে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy