Advertisement
E-Paper

ফলকে শুধু ‘বাবু’র নাম, মুখে মুখে বাবুঘাট

‘‘রানি রাসমণির স্বামী বাবুলাল করেছিলেন এই জায়গাটা। ভাবুন কবেকার’’, গড়গড় করে ইতিহাস বলছিলেন সুরেন্দ্র। হঠাৎ বুঝতে পারলেন ভুল বলেছেন।

ঐতিহাসিক: সংস্কারের পরে আলোকিত বাবুঘাটের প্রবেশপথ। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

ঐতিহাসিক: সংস্কারের পরে আলোকিত বাবুঘাটের প্রবেশপথ। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:৩৬
Share
Save

‘‘চার পুরুষ ধরে এখানেই বসছি। ঠাকুরদার বাবা, ঠাকুরদা, বাবা সকলে এখানেই বসেছেন। এখন আমি বসি। আমাদের কোনও ছুটি নেই। সকাল ৪টে থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত আমাদের এখানেই পাবেন। গঙ্গাপুজো থেকে নারায়ণপুজো, সব করি আমরা।’’— যেখানে দাঁড়িয়ে এই কথা বলছিলেন সুরেন্দ্র পাণ্ডা, বাবুঘাটের সেই অংশের চারপাশে ছোট ছোট কাঠের চেয়ার-টেবিল পাতা। সুরেন্দ্র জানালেন, সবে দু’মাস হল রং করা হয়েছে সেগুলিতে। সুশৃঙ্খল ভাবে বসার সেই জায়গায় হনুমানের ছবি থেকে নারায়ণমূর্তি—আছে সব কিছুই।

‘‘রানি রাসমণির স্বামী বাবুলাল করেছিলেন এই জায়গাটা। ভাবুন কবেকার’’, গড়গড় করে ইতিহাস বলছিলেন সুরেন্দ্র। হঠাৎ বুঝতে পারলেন ভুল বলেছেন। জিভ কাটলেন সুরেন্দ্র— ‘‘ভুল করে ফেলেছি। বাবুলাল নন, রানি রাসমণির স্বামীর নাম ছিল বাবু রাজচন্দ্র দাস।’’ পাশেই দাঁড়িয়ে আর এক বর্ষীয়ান পাণ্ডার মন্তব্য, ‘‘ভুলের আর দোষ কী! বয়স্ক মানুষেরা ছাড়া আর কে-ই বা মনে রেখেছে বাবু রাজচন্দ্রের কথা।’’

ঠিক কথা। অথচ ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ বলছে, রানি রাসমণির অনুরোধে গঙ্গার পাড়ে এই একটি ঘর ও পাকা ঘাট তৈরি করে দিয়েছিলেন তাঁর স্বামী রাজচন্দ্র। ঘাটে প্রবেশের আগে বড়-বড় করে একটি ফলকে লেখাও রয়েছে সে কথা,—‘...দিস ঘাট কনস্ট্রাক্টেড ইন দ্য ইয়ার ১৮৩০ অ্যাট দ্য এক্সপেন্স অফ বাবু রাজচন্দ্র দাস শ্যাল হেয়ারআফটার বি কলড বাবু রাজচন্দ্র দাস ঘাট।’

রাজচন্দ্র দাস নামটি কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিস্মৃতপ্রায়। কলকাতা-গবেষক হরিপদ ভৌমিক বলছেন, ‘‘ওখানে আরও একটি ফলক ছিল। সেখানে বাবুঘাট তৈরির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখা ছিল। কিন্তু এখন আর তা ওখানে নেই। শুধুমাত্র পুরনো বইপত্রেই ওই ফলকের উল্লেখ পাওয়া যায়।’’

স্থাপত্যবিদদের একাংশ জানাচ্ছেন, প্রায় ১৯০ বছরের পুরনো বাবুঘাটে মিলেমিশে গিয়েছে ব্রিটিশ-কলোনিয়াল স্থাপত্যশৈলী। বড়-বড় থামের উপরে ত্রিভুজাকৃতি কাঠামো— এমন ভাবেই তৈরি হয়েছে বাবুঘাটের প্রবেশদ্বার। উঁচু সিলিংয়ের উপরে ফ্যান লাগানো। মূল চাতালের কিছুটা পরেই শুরু হয়েছে সিঁড়ি। যা সোজা নেমে গিয়েছে গঙ্গার বুকে।

মাস তিনেক আগেই বাবুঘাটের সংস্কার করেছে কলকাতা পুরসভা। নতুন রঙের প্রলেপ লাগানোর পাশাপাশি, প্রয়োজনীয় মেরামতির কাজ করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও প্রথমে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। কারণ, বাবুঘাট চত্বর জুড়েই তো ব্রাহ্মণ-পাণ্ডাদের ভিড়। পুরসভার এক পদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘পাণ্ডাদের জায়গা অক্ষুণ্ণ রেখে কী ভাবে এই সংস্কারের কাজ করা যায়, সেটাই ছিল চ্যালেঞ্জ।’’

পুরকর্তারা বলছেন, আরও একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। তা হল গ্রেড ওয়ান হেরিটেজ তালিকাভুক্ত বাবুঘাটের হেরিটেজ শৈলী অবিকৃত রাখা। সংস্কারের কাজ যাতে ঠিক ভাবে করা যায়, তার জন্য পুরসভার হেরিটেজ কমিটির কাছে অনুমোদন চাওয়া হয়েছিল। সেই অনুমোদন পাওয়ার পরেই সংস্কারের কাজ শুরু হয়।

তবে এই সংস্কার কতটা ঠিক ভাবে করা হয়েছে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন হেরিটেজ স্থপতিদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, যে ভাবে হেরিটেজ সংরক্ষণ করার কথা, সেটা অনেক ক্ষেত্রেই মানা হয়নি। রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের সদস্য তথা হেরিটেজ স্থপতি পার্থরঞ্জন দাশ বলেন, ‘‘শুধু বাবুঘাটই নয়, যে ভাবে অন্য ঘাটগুলির সংস্কার করা হয়ছে, তাতে পুরনো ঘাটের আবহ কতটা রয়েছে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছেই।’’

সুরেন্দ্রদের আবার অভিযোগ, সংস্কারের কাজ হলেও বাবুঘাট পরিষ্কারের ক্ষেত্রে উদ্যোগী হয়নি পুর প্রশাসন। কালীপুজো, ছটপুজোর সময়ে বাবুঘাট

কিছুটা পরিষ্কার হলেও অন্য সময়ে যত্রতত্র নোংরা, আবর্জনা পড়ে থাকে। সুরেন্দ্রর কথায়, ‘‘এটা তো ঐতিহাসিক জায়গা। এ ভাবে নোংরা ফেলে রাখলে কি হয়!’’

ঐতিহাসিক তো বটেই। শুধু প্রতিষ্ঠাতা ‘বাবু’ রাজচন্দ্র দাস নামফলকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আলাদা করে তাঁকে আর কেউ মনে রাখেননি। মুখে-মুখে শুধু বাবুঘাট-বাবুঘাট!

Babuaghat Rajchandra Das

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}