সবুজে ঘেরা নিরিবিলি পাড়াটাকে বদলে দিল স্রেফ কতগুলো অফিস!
বছর পনেরো হল মুদিয়ালির এই ছায়া-ছায়া রাস্তাটার বাসিন্দা আমরা। চেনা ঘরবাড়ি, মানুষজন, দোকানপাট, দু’পা গেলেই সিনেমা হল, আরও এগোলেই লেক, তার জল আর খোলা হাওয়া, খানিক দূরের লেক মার্কেট— এ পাড়ায় থাকাটাই বড় শান্তির ছিল। বছর পাঁচেক হল
সেই চৌহদ্দিতেই ঢুকে পড়েছে আস্ত একটা অফিসপাড়া। বাড়িতে বাড়িতে ঘর ভাড়া নিয়ে খুলে গিয়েছে একের পর এক অফিস, কারখানা, গুদাম। রিয়েল এস্টেট থেকে যন্ত্রাংশ, কিছুই বাদ নেই।
ফলে যা হওয়ার ছিল, হলও ঠিক তা-ই। সারা দিন অসংখ্য অচেনা মানুষের আনাগোনা, গাড়ির ভিড়, হর্ন, ধোঁয়া, যানজট আর তুমুল হট্টগোল। ছুটির দিনগুলোয় যেটুকু যা রেহাই মেলে!
বাইরের লোকের তো আর এ পাড়ার প্রতি টান থাকার কথা নয়। নেই-ও। আশপাশের মানুষের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার, পাড়াটাকে ভাল রাখার, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার দায় তাঁদের থাকবেই বা কেন? দোকানদারেরাও এ পাড়ার বাসিন্দা নন। কিন্তু রোজকার যাওয়া-আসা-কথাবার্তায় তাঁদের সঙ্গে একটা যোগাযোগ তৈরি হয়েই যায়। অফিসগুলোতে তো আর পাড়ার লোকেদের যাওয়া-আসা নেই। ফলে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার সুযোগও নেই।
এ পাড়ার আরও একটা বড় সমস্যার জায়গা মোড়ের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। রাস্তার অনেকখানি জুড়ে সেই ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে, সকাল থেকে সে সব ধোওয়া-মোছার কর্মযজ্ঞ চলে। যাতায়াতে রীতিমতো অসুবিধা হয়। সেই সঙ্গে আছে ট্যাক্সিওয়ালাদের যখন-তখন তুমুল চেঁচামেচি, ঝগড়াঝাঁটি, হইচই, তারস্বরে মাইক বাজিয়ে গান চালানো। কিছু বলতে গেলে উল্টে ঝামেলা বাধে আরও। পুলিশকে বলেই বা লাভ হল কই? অথচ পাড়ায় ট্যাক্সিস্ট্যান্ড থাকলে তো বাসিন্দাদের সুবিধাই হওয়ার কথা। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ে ট্যাক্সি মেলেই না, থাকলেও যেতে চায় না।
আরও একটা জিনিস আমার বোঝার বাইরে। এত কাছে লেক। সেখানে এত বড় একটা গেট বসিয়ে ঢোকা-বেরোনো নিয়ন্ত্রিত করে দেওয়া হল। অতখানি খোলা জায়গা, তবু পাড়ার বাচ্চারা সেখানে সাইকেল চালানোর সুযোগ পায় না। আমরা তো ছোটবেলায় সাইকেলেই চষে বেরিয়েছি গোটা পাড়া। শুধু বাচ্চারাই বা কেন, বাড়ির পোষা কুকুরদের একটু ঘুরিয়ে আনার বা খেলতে দেওয়ার জায়গাই বা কোথায়? অথচ রাস্তার কুকুরদের তো কোনও বারণ নেই, তাদের কেউ আটকায়ও না।
এ পাড়ার আর সব কিছুই তো ভাল। তিন-তিনটে বড় পুজো— মুদিয়ালি, শিবমন্দির আর সেবক সঙ্ঘ। পুজোর সময়ে স্রোতের মতো মানুষ আসেন। এত আলো, আনন্দ। বার্ষিক অনুষ্ঠানে নামী শিল্পীরা আসেন। পাড়ার মহিলাদের একটা দল নাটক-শ্রুতিনাটক করে। বছরে একটা পিকনিক হয়। স্বাস্থ্য শিবির বা রক্তদান শিবিরও। সবেতেই হইচই করে অংশ নেয় আমার পাড়া। তবে এখানকার নিজস্ব পুজোটাই এখন দু’ভাগ। আনন্দটাও স্বাভাবিক ভাবে ভাগাভাগি হয়ে হয়ে গিয়েছে। তাতে আমাদের মতো কিছু লোক অবশ্য বড্ড দোটানায় পড়ে। কোন দিকে যাব? দু’তরফেই তো বন্ধুরা। মানসিকতা আলাদা হতেই পারে, কিন্তু মনোমালিন্যটুকু মিটিয়ে নিয়ে এক হয়ে গেলেই তো ভাল হত। যে ভাবে পুজোয় বাইরের লোকের ভিড়টাকে এ পাড়া মানিয়ে-গুছিয়ে নেয়, সে ভাবে যদি নিজেদেরও একটু মানিয়ে
নেওয়া যেত!
নাগরিক পরিষেবাতেও তো অভিযোগের জায়গা নেই। আগেও ভাল ছিল, এখনও তা-ই। নিচু এলাকা, তবে জল জমলেও নেমে যায় খানিক পরেই। জঞ্জাল সাফাই করে পাড়াটাকে যথাসম্ভব সাফসুতরো রাখে পুরসভা। শুধুমাত্র আবাসিক এলাকা হলে হয়তো আরও পরিচ্ছন্ন রাখা যেত, অফিসগুলো এবং সেখানকার গাড়ি-মানুষের ভিড়ে ততটা সম্ভব হয় না। তবে যে কোনও বিষয়ে পুরসভার সহযোগিতা মেলে যথেষ্টই। আইনশৃঙ্খলার দিক থেকেও দিব্যি ঠিকঠাক। পুলিশের টহলদারি আছে, ছিঁচকে চুরিচামারি ছাড়া তেমন কোনও অপরাধ হয় না।
শিক্ষিত পাড়া। উচ্চ মধ্যবিত্তের বাস। পাড়াটাকে ভাল রাখার ক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই যথেষ্ট সচেতনতা আছে। যার যার নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকলেও তা কখনও সে ভাবে বড় হয়ে ওঠে না। ফলে এ পাড়ায় তেমন রাজনীতির রং নেই। মানুষগুলোও মিলেমিশেই তো থাকেন। বাঙালি তো বটেই, এ পাড়ার একটা বড় অংশ দক্ষিণী। তাঁদের সংস্কৃতি, তাঁদের মন্দির, ভাবনাচিন্তা সবই দিব্যি মিশে গিয়েছে এ পাড়ার ভরপুর বাঙালিয়ানায়। বিপদে-আপদে পাশে থাকা, নিত্য যোগাযোগ সবই আছে। সবাই বলে এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পাড়ার যোগাযোগ কম। ব্যস্ততার কারণে সময় দিতে না পারলেও ইন্টারনেটের দৌলতে ওরাও তো নিজের মতো করে যোগাযোগ রাখে।
এ পাড়া এখনও খুব সবুজ। পুরনো, খোলামেলা সব বাড়ি। আকাশছোঁয়া বহুতল সে ভাবে এখনও থাবাও বসাতে পারেনি। এ পাড়াটা কলকাতার মডেল পাড়া হতেই পারত। অবস্থানের দিক দিয়ে, পরিবেশের দিক দিয়ে, মিলেমিশে থাকার দিক দিয়ে। বাদ সাধছে
ক্রমশ সংখ্যায় বাড়তে থাকা ওই অফিসগুলো আর ট্যাক্সিস্ট্যান্ড আর লেক চত্বরে ইচ্ছেমতো ঘোরাঘুরির সুযোগ কেড়ে নেওয়া। এগুলো তো সামাজিক দূষণ বলা চলে। তা বন্ধ করবে কে? পুরোদস্তুর আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যের বসত না-ই বা হল। না হয় থাকল না ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের হট্টগোল। না হয় লেকের দিকটায় ইচ্ছেমতো খেলতে বা ঘুরতে পারল বাচ্চাগুলো! নগরজীবনের ভারসাম্য বজায় রাখার ভারটা তো নাগরিক এবং প্রশাসন, দু’তরফেরই।
লেখক বিশিষ্ট অভিনেতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy