সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্য যে দুই নার্সিং পড়ুয়ার ছবি ছড়িয়েছে, বুধবার আদালতে তাঁদের এক জনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বচসা পশুপ্রেমীদের (বাঁ দিকে)। কুকুর-কাণ্ডের পরে ছড়িয়েছে এমনই মিম (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র
প্রথমে প্রতিবাদ। তার পরে প্রতিরোধ। তাতেও কাজ না হলে ভিডিয়ো করো!
সাম্প্রতিক একাধিক ঘটনা দেখে সাইবার-বিশেষজ্ঞ, সমাজতত্ত্বের শিক্ষক থেকে মনোরোগ চিকিৎসক— সকলেই বলছেন, বিপক্ষকে শায়েস্তা করার মূল হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ‘স্মার্ট ফোন’। তাতে রেকর্ড করা ছবি বা ভিডিয়ো দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে। আর আইনের সওয়াল-জবাব পেরিয়ে সেখানেই দ্রুত ‘ট্রায়াল’ বা বিচার শুরু হয়ে যাচ্ছে! বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যার ফল হচ্ছে মারাত্মক! সাইবার-বিশেষজ্ঞ সন্দীপ সেনগুপ্ত যেমন বলছেন, ‘‘অনেক ক্ষেত্রে যাঁকে দোষী হিসেবে দেগে দেওয়া হচ্ছে, তিনি হয়তো ঘটনাটাই জানেন না। যত ক্ষণে জানছেন, তত ক্ষণে সোশ্যাল সাইটে তিনি অপরাধী! এর ফল কী হতে পারে, ভাবা দরকার।’’
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সাম্প্রতিক কুকুর-নিধনের ঘটনার পরেও দেখা গিয়েছে, দুই নার্সের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সত্যাসত্য যাচাই না করেই। পরে জানা যায়, ওই হাসপাতালের সঙ্গে তাঁদের কোনও যোগাযোগই নেই এখন। পরে ওই ঘটনায় গ্রেফতার হন অন্য দুই নার্সিং পড়ুয়া। হেনস্থার শিকার এক নার্স জানিয়েছেন, এক সময়ে বাধ্য হয়ে তাঁকে তাঁর সোশ্যাল সাইটের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে হয়। কর্মক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ে। ইতিমধ্যেই ওই দুই নার্স পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার এক নার্সের স্বামী শিয়ালদহ আদালতের সামনে প্রতিবাদ জানাতে এলে পশুপ্রেমীরা তাঁদের উপরে চড়াও হন। পুলিশ গিয়ে তাঁকে বাঁচিয়ে বার করে দেয়।
আরও পড়ুন: দার্জিলিংয়ের হ্যাপি ভ্যালিতে দেখা মিলল চিতাবাঘের
একই ভাবে গত কয়েক দিন ধরে সোশ্যাল সাইটে চিকিৎসক, নার্সদের সঙ্গে পশুপ্রেমীদের দ্বৈরথ চরম আকার নিয়েছে। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের বিরুদ্ধে সরাসরি কলকাতা পুলিশে অভিযোগ করেছে চিকিৎসক সংগঠন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম’। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালের ভিতরে রোগীদের সামনেই ওই গবেষক চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অপমানজনক মন্তব্য করেছেন। তাঁর মন্তব্য চিকিৎসকদের তরফে সোশ্যাল সাইটে তুলে ধরে প্রতিবাদ জানানো হয়। ওই গবেষক এ দিন বলেন, ‘‘জোড়াসাঁকো থানার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। প্রয়োজনে আমিও সাইবার অপরাধ দমন বিভাগে গিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করব।’’ এ ক্ষেত্রেও প্রশ্ন, আইনের দ্বারস্থ হওয়ার আগেই সোশ্যাল সাইটে গিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি করা হল কেন?
সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র বলছেন, ‘‘হাতের কাছে যা পাচ্ছি, তা-ই সোশ্যাল সাইটে তুলে দেওয়াটাকেই এখন সামাজিকতা ভেবে নেওয়া হচ্ছে। এটা করতে পারা মানেই সামাজিক হতে পারা নয়।’’ মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব বলছেন, ‘‘এটা একটা সামাজিক সমস্যার চেহারা নিচ্ছে। হাতের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই ভাবা প্রয়োজন।’’
যদিও আইনজীবী সৌম্যজিৎ রাহা জানাচ্ছেন, কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁর ছবি বা ভিডিয়ো ছড়িয়ে দেওয়া নিয়ে সাইবার আইনে আলাদা করে কোনও ধারা নেই। দুই নার্সের অভিযোগ এ ক্ষেত্রে মানহানির ধারায় ফেলে দেখার কথা। সৌম্যজিৎবাবুর কথায়, ‘‘এ ক্ষেত্রে আলাদা ধারা নেই ঠিকই, তবে সোশ্যাল সাইটে কাউকে অকারণ কাঠগড়ায় তুললে কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করার অবকাশ ভারতীয় দণ্ডবিধিতেই রয়েছে।’’ আর আহমেদ ডেন্টাল কলেজের সেই পড়ুয়া, যাঁর ভিডিয়োর জেরে এনআরএস-কাণ্ডে দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, সেই সৌরভ চক্রবর্তী এ দিন বলেন, ‘‘আমরা প্রতিবাদ করছি দেখেও যখন ওই নার্সিং পড়ুয়ারা শুনলেন না, তখন আমার বন্ধুই বলল, ভিডিয়ো করো। মাধ্যমকে কী ভাবে ব্যবহার করছি, সেটাই মনে হয় বড়।’’
এন্টালি থানার সামনে বিক্ষোভকারী পশুপ্রেমীদের দিকে মোবাইল তাক করে মঙ্গলবার ভিডিয়ো তুলতে দেখা যায় ওই থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিককেও। তিনিও এ দিন বলেন, ‘‘সোশ্যাল সাইটের কার্যকারিতাকে কিন্তু কিছুতেই অস্বীকার করার নয়। ‘বন্দুক’ কী কাজে ব্যবহার করছেন, সেটাই বড় কথা!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy