কাশেম
উস্তাদ কাশেম আট।
কম যায় না তার চেলা খইরুল ওরফে মুন্নাও। এ-পর্যন্ত সে-ও আট।
মানে আট-আটটি মেয়েকে বিয়ে করেছে দু’জনেই। বংশবৃদ্ধির জন্য বিয়ে নয়। মেয়ে ব্যবসার তাগিদে পরের পর বিয়ে। অর্থাৎ তাদের বিয়ে একটা ফাঁদ। সুখী জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে গরিব-গুর্বো মেয়ে ধরার ফাঁদ। তার পরে সেই মেয়েদের দিল্লি-সহ ভিন্ রাজ্যে পাচার। এবং বিক্রি।
কিন্তু কোন ফাঁদে ধরা পড়ল কাশেম বা মুন্না? কী ভাবে জানা গেল তাদের মেয়ে পাচার ও বিক্রির খবর?
সে-রাতে ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। হেঁটে একটি একতলা বাড়ির সামনে পৌঁছলেন জনা কুড়ি যুবক। সঙ্গে দু’জন মহিলা। ওঁরা ঘিরে ফেললেন বাড়িটি। দরজায় ধাক্কা মারলেন তিন যুবক। দরজা খুলতেই আগন্তুকদের তিন জন চ়ড়াও হলেন একটি ঘরে। খাটে শুয়ে থাকা এক ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে তাঁরা রওনা হলেন থানার দিকে।
হানাদারেরা দুষ্কৃতী নন। গোয়েন্দা পুলিশ। সিআইডি-র দাবি, রবিবার রাতে এ ভাবেই জয়নগরের মনিরতট গ্রামের একটি বাড়ি থেকে গোয়েন্দারা গ্রেফতার করেছেন নারী পাচার চক্রের অন্যতম পান্ডা কাশেমকে। তার বিরুদ্ধে দিল্লি, গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ-সহ বিভিন্ন রাজ্যে নারী পাচারের অনেক মামলা রয়েছে। দীর্ঘদিন পরে রবিবার বাড়ি ফিরেছিল কাশেম। এবং পত্রপাঠ গোয়েন্দাদের কব্জায়।
কী ভাবে মেয়ে পাচারের কারবার চালাচ্ছিল কাশেম?
সিআইডি জানাচ্ছে, দু’ধরনের মোক্ষম টোপ বেছে নিয়েছিল কাশেম। প্রেম-প্রেম খেলা আর বিয়ে। এবং ভাল চাকরি। বিভিন্ন রাজ্যে এজেন্ট ছড়িয়ে দিয়ে তাদেরও মূলত ওই দু’টি টোপ ব্যবহারেরই প্রশিক্ষণ দিত সে। সেই এজেন্টরা টোপ ফেলে গরিব পরিবারের মেয়েদের বিয়ে করত। তার পরে চাকরি দেওয়ার নাম করে তাদের পাচার করে দিত কাশেমের কাছে। কাশেম সেই মেয়েদের বিক্রি করে দিত ভিন্ রাজ্যে। নিজেকে বাঁচানোর জন্য বিশেষ একটি কৌশল অবলম্বন করত কাশেম। মোবাইল ফোনে কখনওই কোনও কথা বলত না। ফলে তার খোঁজ পেতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল সিআইডি-কে। সোর্স মারফত গোয়েন্দারা রবিবারেই খবর পান যে, কাশেম মনিরতটের একটি বাড়িতে উঠেছে। স্থানীয় পুলিশের সাহায্য নিয়ে সিআইডি-র একটি দল সন্ধ্যায় হানা দেয় ওই বাড়িতে। দেখা যায়, ঘরে শুয়ে আছে কাশেম।
আর মুন্নাকে ধরা গেল কী ভাবে?
সিআইডি জানিয়েছে, জুলাইয়ে জয়নগর থেকে নিখোঁজ হয়ে যায় এক চতুর্দশী কিশোরী। বিভিন্ন সূত্রে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, ওই কিশোরীকে দিল্লিতে পাচার করা হচ্ছে। তখন থেকেই তক্কে তক্কে ছিলেন গোয়েন্দারা। সতর্ক অপেক্ষার ফল মেলে অক্টোবরে। দিল্লিগামী কালকা মেল থেকে উদ্ধার করা হয় ওই কিশোরীকে। মেয়েটি জানায়, খইরুল ওরফে মুন্না নামে এক যুবকের সঙ্গে তার প্রণয়-সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাকে বিয়েও করে সেই যুবক। তার পরে ভাল চাকরি জুটিয়ে দেওয়ার টোপ গিলিয়ে মেয়েটিকে উত্তরপ্রদেশ নিয়ে যাচ্ছিল সে। সিআইডি দেখেই পালিয়ে যায় মুন্না। পরে তাকে ধরে ফেলে সিআইডি। মুন্নাকে জেরা করে জানা যায়, মেয়েটিকে কাশেমের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার ছক কষেছিল সে। তার আগেও সে বিয়ের টোপ দিয়ে অন্তত আটটি কিশোরীকে দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে কাশেমের কাছে বেচে দিয়েছে।
কাশেম ধরা পড়ার পরে জানা যায়, ব্যবসার খাতিরে তার নিজের বিয়ের সংখ্যাটাও অন্তত আট। এর বাইরে আছে তার অন্যান্য এজেন্টের বিয়ে ও মেয়ে পাচার। সংখ্যাটা মোট কত, ভেবে কূল পাচ্ছেন না গোয়েন্দারা। তদন্তকারীদের অনুমান, শুধু জয়নগর, ক্যানিং, ডায়মন্ড হারবার এলাকা থেকে ১৫ জনেরও বেশি কিশোরীকে বিয়ে করে বাইরে পাচার করে দিয়েছে কাশেমের চক্র। সেই কিশোরীদের অনেকেই এখন দেশের বিভিন্ন যৌনপল্লিতে আছে।
এক তদন্তকারী অফিসার সোমবার বলেন, ‘‘কাশেম ওই চক্রের মূল পান্ডা। দিল্লিতে তার একটি বাড়ি আছে। এ রাজ্যের কিশোরীদের প্রথমে রাখা হতো সেখানেই। পরে খদ্দের মিললে তাদের বিক্রি করে দেওয়া হতো। এ রাজ্যে কাশেমের বেশ কিছু এজেন্টের হদিস মিলেছে। তাদের খোঁজ চলছে।’’ গোয়েন্দাদের আশা, কাশেমকে জেরা করে এ রাজ্য থেকে পাচার হওয়া আরও কয়েক জন কিশোরীর হদিস মিলতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy