Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Doctor Sandip Ghosh

দু’বার বদলির পর ফেরেন আরজি করের অধ্যক্ষের পদে, সকালে ইস্তফার পর বিকালে বহাল! তিনি সন্দীপ

স্বাস্থ্যভবনে সন্দীপের ‘প্রভাব’ বিস্তর। সম্ভবত তাই সকালে আরজি করের অধ্যক্ষের পদে তিনি ইস্তফা দিলেও বিকালে তাঁকে ন্যাশনাল মেডিক্যালের অধ্যক্ষ পদে বদলি করা হয়েছে।

R G kar Medical colleges principal Sandip Ghosh resigns, who is Sandip Ghosh

আরজি করের অধ্যক্ষ পদ থেকে ইস্তফার পরে ন্যাশনাল মেডিক্যালের অধ্যক্ষ করা হয়েছে সন্দীপ ঘোষকে। ছবি: সংগৃহীত।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০২৪ ১৭:৫৬
Share: Save:

তিনি ‘স্বেচ্ছায়’ ইস্তফা দেওয়ার পরে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, যে ভাবে তাঁকে গালিগালাজ করা হয়েছে, তাতে তাঁর খুব খারাপ লেগেছে। সে জন্যই তিনি স্বেচ্ছায় আরজি করের অধ্যক্ষের পদে ইস্তফা দিয়েছেন। তিনি ছেড়ে দিয়েছেন চাকরিও। তবে চাকরিতে ইস্তফা দিলেও রাজ্য সরকার তাঁকে অন্য কোথাও সরিয়ে দেবে।

তাঁর নাম করে তাঁর সম্পর্কে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।

তাঁর সম্পর্কে চিকিৎসকদের সংগঠনের নেতা প্রকাশ্যে বলেন, ‘‘আমরা ওঁকে ‘ডাক্তার’ বলতে রাজি নই। উনি যদি ডাক্তার হন, তা হলে আমরা ডাক্তার নই! ওঁকে বরখাস্ত করা হোক!’’

সকালে একটি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর বিকালেই তাঁকে আবার শহরেরই অন্য একটি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের পদে বহাল করা হয়।

তিনি— সন্দীপ ঘোষ। সোমবার সকালে যিনি প্রথমে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। তার পরে স্বাস্থ্যভবনে গিয়ে সরকারি চাকরি থেকেই ইস্তফা দিয়েছেন। ঘটনাচক্রে, যিনি আবার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজেরই প্রাক্তনী!

আরজি কর হাসপাতালে নারকীয় কাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর থেকেই আন্দোলনকারীদের নিশানায় সন্দীপ। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ (যার সব ক’টিই অবশ্য তদন্ত এবং প্রমাণসাপেক্ষ) বিস্তর। অভিযোগ, ওই হাসপাতালে বিভিন্ন ‘দুষ্কর্মের’ সঙ্গে জড়িত থাকার। অভিযোগ, হাসপাতালে ন্যক্কারজনক ঘটনাটির তথ্যপ্রমাণ লোপাট করার এবং মৃতার বাড়িতে ফোন করে বলার যে, ওই চিকিৎসক আত্মহত্যা করেছেন। বলা হচ্ছে, সন্দীপ বলতে পারতেন, ওই যুবতীর ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’ হয়েছে। তা না-বলে আগ বাড়িয়ে কেন তিনি বললেন, ঘটনাটি ‘আত্মহত্যার’? শেষ অভিযোগটি অবশ্য সন্দীপ খণ্ডন করেছেন। তাঁ কথায়, ‘‘এটা একেবারে ভুল কথা। আমি কখনও এটা করিনি। আমার মুখে এই কথাগুলো বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমি কাউকে আড়াল করার চেষ্টা করিনি।’’ কিন্তু তাতে ভবি ভুলছে না। চিকিৎসক সংগঠনের সদস্যেরা বলছেন, ‘‘উনি ইস্তফার নাটক করছেন! তাঁর নাকি খুব দুঃখ হয়েছে! ওঁকে কোথাও বদলি নয়। ওঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি তদন্ত করতে হবে। উনি ঘটনার তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করেছেন।’’

গত শুক্রবার থেকে সারা রাজ্যে পরিচিত হয়ে গিয়েছেন সন্দীপ। মুখে মুখে ঘুরছে তাঁর ‘প্রভা’ এবং ‘প্রতাপ’-এর কথা। বলা হচ্ছে, তাঁর ঘরে যেতে গেলে চার স্তরীয় নিরাপত্তা পেরিয়ে যেতে হত। তিনি সরকারি নিরাপত্তাও পেতেন। শনিবার থেকে সমাজমাধ্যমে তাঁর একটি ছবি অহরহ ঘুরছে। গাঢ় নীল ট্রাউজ়ার্সে গোঁজা সাদা ফুলহাতা শার্ট। মুখ, মাথা, জামার সামনের অংশে সবুজ আবিরে মাখামাখি। আঙুলে ‘ভি’ অর্থাৎ ‘ভিকট্রি’ চিহ্ন। বিজয়। কথিত: ওই আবির লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশের দিন তৃণমূলের জয়ের।

সবুজ আবির মাখার কারণ তৃণমূলের বিজয় উদ্‌যাপন। দু’আঙুলে ‘ভি’ দেখানোর কারণ ছিল তৃণমূলের জয়কে নিজের জয় হিসেবে দেখানো। আরজি কর-কাণ্ডের পর থেকে বিরোধীরা তো বটেই, সমাজমাধ্যমও বলছে, সন্দীপ ওই ছবিতে আসলে নিজের ‘তৃণমূল-ঘনিষ্ঠতা’ই জাহির করতে চেয়েছিলেন। তিনি যে শাসকদলের ‘আস্থাভাজন’, তা-ই বোঝাতে ওই আবির। ওই উল্লাস। ওই ছবি। বস্তুত, ওই ছবির সূত্রেই সন্দীপকে ‘শাসকদলের লোক’ বলে পরিচয় দিতে শুরু করেছেন তাঁরাও, যাঁরা তাঁকে চেনেনও না। তবে আরজি করে কান পাতলে অন্য কিছু শোনা যায় না। যেমন শোনা যাচ্ছে তিনি ‘শাসকদলের ঘনিষ্ঠ’, তেমনই শোনা যাচ্ছে, শাসকদলের অন্য একটি গোষ্ঠীকে মাঠের বাইরে রেখে নিজেই ময়দানের ‘দখল’ নিতে বিভিন্ন ভূমিকা নিয়েছিলেন সন্দীপ।

হাসপাতালেরই একটি সূত্রের বক্তব্য, স্বাস্থ্যভবনে নিজস্ব ‘প্রভাব’ বিস্তার করেছিলেন সন্দীপ। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে তাঁকে একাধিক বার বদলি করা হলেও অল্প সময়েই তিনি ফিরে এসেছিলেন আরজি করের অধ্যক্ষের পদে। এক বার সন্দীপের পরিবর্তে উলুবেড়িয়ার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ সনৎ ঘোষকে আরজি করে আনা হয়েছিল। কিন্তু কোনও এক ‘অজ্ঞাত’ কারণে অল্প সময়ের মধ্যে ফের সন্দীপ ফিরে আসেন। দ্বিতীয়, গত সেপ্টেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্পেন-দুবাই সফরের আগেই সন্দীপকে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের অস্থি বিভাগে বদলি করা হয়েছিল। ২১ দিনের মাথায় আবার তিনি আরজি করে আসীন। সোমবার স্বাস্থ্যভবনের এক কর্তা বলেন, ‘‘এমন অভিনব বদলি বোধ হয় সাম্প্রতিক কালের মধ্যে কারও হয়নি।’’

সরকারি স্তরে স্বাস্থ্য আধিকারিকদের অনেকে তো বটেই, শাসকদলেরও অনেকে একান্ত আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন সন্দীপ ‘প্রভাবশালী’। কিন্তু নেপথ্যে কে? নাম নিচ্ছেন না কেউ। তবে বলছেন, রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রশাসনে যে ‘সমান্তরাল’ ব্যবস্থা চলে, সন্দীপ তারই ‘ক্ষতিকর ফসল’।

বেলেঘাটার বাসিন্দা সন্দীপ আরজি করেরই প্রাক্তনী। দুই সন্তানের পিতা। সোমবার চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর তিনি বলেছেন, ‘‘কিছু করে খেতে পারব।’’ এ-ও বলেছেন, ‘‘আমি যখন আরজি কর মেডিক্যালের দায়িত্ব নিয়েছিলাম, তখন এখানে ঘুঘুর বাসা ছিল। বার্থ সাটিফিকেট নিতেও ঘুষ দিতে হত। কোনও কোনও নেতার মদতও ছিল। আমি সেগুলো বন্ধ করেছি। তাই আমার এত বিরোধিতা।’’

তবে দফায় দফায় আরজি করের অধ্যক্ষের দায়িত্ব সামলানো সন্দীপের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে বলে দাবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের একাংশের। হাসপাতালের সরঞ্জাম পাচার, তহবিল তছরুপ, স্টাফ কোয়ার্টারে বেআইনি ভাড়াটে বসানো, ফেল করানোর ভয় দেখিয়ে ডাক্তারি পড়ুয়াদের নিজের দিকে রাখা, বেআইনি পার্কিং থেকে টাকা তোলার মতো অভিযোগও তুলছেন কেউ কেউ। এমনকি, শাসকদলের ‘ঘনিষ্ঠ’ এক চিকিৎসক এ-ও বলেছেন, ‘‘সন্দীপ যা যা করেছেন, তা যে প্রশাসন জানে না, তা নয়। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে পদক্ষেপ করা হয়নি।’’

আরজি করের প্রশাসনে তৃণমূলের অন্দরের সমীকরণে বরাবরই সন্দীপ ছিলেন প্রাক্তন সাংসদ তথা চিকিৎসক শান্তনু সেনের বিরোধী গোষ্ঠীর। অনেকে বলেন, শান্তনুকে রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরানোর নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছিলেন সন্দীপই। যদিও শান্তনু এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য, ‘‘গোটা বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী নিজে সংবেদনশীলতার সঙ্গে দেখছেন।’’

হাসপাতালের মধ্যে মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার গোড়া থেকে সন্দীপ যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, তা নিয়েও তৃণমূলের একাংশ ক্ষুব্ধ। তাঁদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী নিজে নিহত চিকিৎসকের বাড়ি পৌঁছে যেতে পারলেন। কিন্তু গত পাঁচ দিনে তিনি এক বার সোদপুরের ওই বাড়িতে যাওয়ার সময় পেলেন না? ঘটনার পরে কয়েক জন ইন্টার্নকে হস্টেল ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ অধ্যক্ষের তরফেই দেওয়া হয়েছিল কি না, সে প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ। উত্তর কলকাতার এক ‘প্রভাবশালী’ তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘এই ঘটনা দিয়ে সন্দীপকে বিচার করলে চলবে না। সন্দীপের জন্য ওই বাংলা প্রবাদটাই খাটে— কচুগাছ কাটতে কাটতেই লোকে ডাকাত হয়। গোড়াতেই ওঁকে ধরা উচিত ছিল।’’ বস্তুত, ঘরোয়া আলোচনায় সন্দীপের ইস্তফাকে শাসকদলের অনেক নেতাও ‘নাটক’ বলে অভিহিত করছেন। অনেকের আবার প্রশ্ন—এই ইস্তফা তদন্তের আওতার বাইরে থাকতে নয় তো? কারণ, সকালে আরজি করের অধ্যক্ষের পর থেকে ইস্তফা দেওয়ার পরে বিকালেই তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ন্যাশনাল মেডিক্যালের অধ্যক্ষের পদে।

অন্য বিষয়গুলি:

R G Kar Hospital R G Kar Medical College and Hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy