Advertisement
E-Paper

কুনাট্যের পরম্পরা

রাজ্যের প্রশাসন যাঁরা চালাচ্ছেন, সাধারণ ভাবেই শিক্ষার প্রতি তাঁদের বিন্দুমাত্র অনুরাগ বা দায়িত্ববোধের পরিচয় মেলে না। যাদবপুরের ক্ষেত্রে দৃশ্যত তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দলীয় সাম্রাজ্য বিস্তারের উদগ্র বাসনা।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৫ ০৮:৩৩
Share
Save

মার্চ মাসের প্রথম দিন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অশান্তির নতুন পালা শুরু হয়েছিল, তার পরে পক্ষকাল অতিক্রান্ত। তিথির হিসাবে শুক্লপক্ষ, কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে অতিক্রান্ত হয়েছে এক ঘোর কৃষ্ণপক্ষ, উত্তরোত্তর যা ঘোরতর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে চলেছে। অতি সম্প্রতি উৎকর্ষ বিচারের একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির যে সংবাদ মিলেছে, তা সেই অন্ধকারকেই আরও প্রকট এবং আরও উদ্বেগজনক করে তোলে। ‘কিউএস’ ক্রমের তালিকায় গত বছরের ৭৪১-৭৫০ স্তর থেকে এ বছর ৭২১-৭৩০ স্তরে উত্তরণ জানিয়ে দেয়, রাজ্যের তমসাচ্ছন্ন শিক্ষার মানচিত্রে অল্প কয়েকটি ব্যতিক্রমের অন্যতম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও গুণমান ধরে রাখা কতটাই জরুরি। অথচ প্রতিষ্ঠানটিকে ক্রমাগত তার উল্টো দিকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। এক দিকে রাজ্যের দুরাচার-সর্বস্ব শাসককুল ও তাঁদের অনুগামী তথা বশংবদ শিক্ষক-আধিকারিকবর্গ এবং অন্য দিকে সঙ্কীর্ণ দলীয় ও গোষ্ঠীগত স্বার্থের তাড়নায় চালিত সুযোগসন্ধানী ও প্রায়শই ধ্বংসাত্মক প্রতিবাদের রকমারি ধ্বজাধারীরা— দুই তরফের সৌজন্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটে চলেছে, তাকে মুষলপর্ব বললে কম বলা হয়।

রাজ্যের প্রশাসন যাঁরা চালাচ্ছেন, সাধারণ ভাবেই শিক্ষার প্রতি তাঁদের বিন্দুমাত্র অনুরাগ বা দায়িত্ববোধের পরিচয় মেলে না। যাদবপুরের ক্ষেত্রে দৃশ্যত তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দলীয় সাম্রাজ্য বিস্তারের উদগ্র বাসনা। যে ভাবে হোক এই প্রতিষ্ঠানের পরিসরটিকে নিজেদের দখলে আনার তাগিদ শাসক শিবিরের আচরণে বারংবার প্রকট হয়ে ওঠে। এ-বারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি, উপরন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুলিশ-প্রশাসনের অতিরিক্ত তৎপরতা। ১ মার্চ ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ডাকব না’ ঘোষণা করে শিক্ষামন্ত্রী যে নাটকীয় দৃশ্যের জন্ম দিয়েছিলেন, পরবর্তী অধ্যায়ে ‘সাদা পোশাক’-এ পুলিশের প্রবেশ ও অবাধ বিচরণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিক্ষার্থীকে থানায় ডেকে পাঠানো এবং আটক করা অবধি ঘটনাবলি ক্রমাগত সেই দৃশ্যের নাটকীয়তাকেই চিনিয়ে দিয়ে চলেছে। এবং, শেষ অবধি পেশ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারের সামনে পুলিশের ফাঁড়ি বসানোর প্রস্তাব। এই প্রস্তাবের অন্তরালে শিক্ষামন্ত্রীর (বা তাঁর ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের) কোনও (অনু)প্রেরণা আছে কি না, সেই জল্পনা অস্বাভাবিক নয়। তবে সন্দেহ নেই, এমন একটি ঘটনাপরম্পরায় মন্ত্রীর নাট্যকার-সত্তা পুলকিত হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ দূষণ নিয়ে তাঁর আক্ষেপ ও দীর্ঘশ্বাস হয়তো সেই পুলকেরই নাটকীয় প্রকাশ!

অন্য দিকে, শাসকদের অন্যায় ও অনাচারের বিরুদ্ধে যাঁরা প্রতিবাদ শাণাচ্ছেন, তাঁদের আচরণও অনেকাংশেই অত্যন্ত আপত্তিকর। শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে তাঁদের বিক্ষোভ যে হিংসাত্মক চেহারা নিয়েছিল, তার পক্ষে কোনও সুযুক্তি থাকতে পারে না। যাঁরা প্রতিবাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলে এই আচরণকে সমর্থন করতে চান, তাঁদের কাছে প্রকৃত গণতন্ত্রের কোনও মূল্য নেই। ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচন থেকে শুরু করে কর্মসমিতির বৈঠক আয়োজন অবধি সমস্ত দাবিই অত্যন্ত ন্যায্য ও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তা কখনওই বিধ্বংসী হঠকারিতার যুক্তি হতে পারে না। বস্তুত, এই হঠকারিতাই যাদবপুরে কেন্দ্রীয় শাসক শিবির ও তার অনুগামী নানা গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব খেলার সুযোগ করে দিয়েছে, সেই সুযোগ কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে উঠেছে তারা। রাজ্যের শাসকদের দায়িত্ববোধ যদি বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট থাকে, তবে নিজেদের তৈরি করা কদর্য ইমারতটির খোলনলচে বদলানোই তাঁদের কাজ। কেবল যাদবপুরে নয়, সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দলীয় স্বার্থের কথা না ভেবে সর্বত্র ছাত্র ইউনিয়নের সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা তার একটি অঙ্গমাত্র। কিন্তু তাঁরা সে-কাজ করতে চান, এমন কোনও ভরসা দিগন্তেও দেখা যাচ্ছে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Jadavpur University

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}