সেটা ১৯৮৩ সালের কথা।
স্কুল অব ট্রপিকাল মেডিসিন-এর চর্মরোগ বিভাগে আসা এক রোগীকে পরীক্ষা করে বিভাগের তৎকালীন প্রধান ক্ষিতীশচন্দ্র সাহা প্রথম জানতে পারেন যে ওই ব্যক্তি আর্সেনিক দূষণের শিকার। আর তা যে নলকূপের জলের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করছে তা-ও জানিয়েছিলেন তিনি। তৎকালীন রাজ্য সরকার সে কথায় আমল দেয়নি। কিন্তু এর পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সমীক্ষা করে রিপোর্ট দিল, বিশ্ব সংস্থা বা হু সরব হল। বিশ্বের নজর পড়ল পশ্চিমবঙ্গের আর্সেনিক দূষণে। মোকাবিলায় তৈরি হল টাস্ক ফোর্স। কেন্দ্রের টাকা এল। অর্থ নিয়ে এল ইউনিসেফ। কিন্তু সরকারি কমিটি থেকে বাদ ক্ষিতীশবাবু। ব্রাত্য করে রাখা হল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালেয়র স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ-এর প্রধান গবেষক দীপঙ্কর চক্রবর্তীকে।
সেটা ১৯৯১।
এর পরে আর্সেনিক নিয়ন্ত্রণে কম টাকা আসেনি রাজ্যে। নিজেদের মতো সমীক্ষা করে সেই টাকা কী ভাবে ব্যয় করা হবে তার নির্ঘণ্টও তৈরি হল। কমিটি হল, দফায় দফায় বৈঠক হল পাঁচতারা হোটেলে, আর্সেনিক আক্রান্ত মানুষদের তেমন লাভ হল না। ১৯৯৩ সালে দীপঙ্করবাবুরা পুরসভার যাদবপুর এলাকার গভীর নলকূপের জলে পেলেন বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক। রোগীর শরীরে মিলল দূষণের চিহ্ন। পুরসভা সেই রিপোর্টকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিল।
২০০০ সালে ফের দক্ষিণ কলকাতা ও শহরতলির নলকূপে বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক পেল স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ। পুরসভা তা মানল না। পুরকর্তারা বললেন, সমীক্ষার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে তাঁদের সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু ওই রিপোর্টকে ভিত্তি করে সমীক্ষা চালিয়ে রাজ্যের আর্সেনিক টাস্ক ফোর্স যাদবপুর-সহ দক্ষিণ কলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকাকে আর্সেনিকপ্রবণ বলে ঘোষণা করেছিল ১৯৯৫ সালেই। সেই সব অঞ্চলে গভীর নলকূপ বসানো নিষিদ্ধ করতে বলেছিল টাস্ক ফোর্স। বলেছিল ওই সব এলাকার সব নলকূপের জল পরীক্ষা করতে হবে। মহানগরীর জলস্তরের অবস্থা কী তা নিয়ে সমীক্ষার কথাও বলা হয়েছিল।
কিন্তু পরের ২০ বছরে কলকাতার ভূগর্ভের জলস্তরের কোথায় কী অবস্থা তা নিয়ে সমীক্ষার পরিকাঠামোই তৈরি করতে পারেনি পুরসভা। তৈরি হয়নি নিয়মিত জল পরীক্ষার পরিকাঠামোও।
২০১১’র ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতার ভূগর্ভের অবস্থা নিয়ে সমীক্ষা করে কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা কেন্দ্রীয় ভূ-জল নিগম। কলকাতা পুরসভার কাছ থেকে সমীক্ষকরা যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন তাতে দেখা যাচ্ছে মহানগরীতে শেষ বারের মতো নলকূপের জলে আর্সেনিকের পরিমাণ মাপা হয়েছিল ২০০৩’র ১৫ জুন। ওই তথ্য মতো ২০০০’র ২ মে থেকে পরবর্তী তিন বছরে মহানগরীর ৭৭টি গভীর নলকূপের জলে আর্সেনিকের পরিমাণ মেপেছিল পুরসভা। যে সব গভীর নলকূপের জল পুরসভা মেপেছে তার শতকরা ৯০ ভাগই তাদের বসানো নলকূপ বা সরকারি ভবনের। কোনও বহুতল বা বেসরকারি ভবনের নলকূপের জল তারা পরীক্ষা করেনি।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, আলিপুরের প্রশাসনিক ভবন, কেন্দ্রীয় সরকারের আবাসন, আবহাওয়া দফতর, জাতীয় গ্রন্থাগারের জলে বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক পাওয়া গিয়েছিল সমীক্ষায়। যাদবপুর-টালিগঞ্জ এলাকার প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড, প্রিন্স গোলাম হোসেন শাহ রোড, এনএসসি বসু রোড, ব্রহ্মপুর, অরবিন্দ পার্কের কিছু গভীর নলকূপের জলেও পাওয়া গিয়েছিল বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক। পুরসভার দাবি, সেগুলি বন্ধ করে দিয়েছে তারা। কিন্তু ওই সব নলকূপের আশপাশে আর যে সব বাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল বা বহুতলে গভীর নলকূপ ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলির জল পরীক্ষার ব্যবস্থা পুরসভা করেনি।
প্রসঙ্গত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজি এবং বসু বিজ্ঞান মন্দিরের কয়েক জন গবেষকও গবেষণা করছেন আর্সেনিক দূষণ নিয়ে। তাঁদের কাছে কলকাতা পুরসভা কোনও সময়েই পরামর্শ নিতে যায়নি। যেচে সাহায্য দিতে গিয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ-এর গবেষকরা, তাঁদের সমীক্ষার যথার্থতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে পুরসভা।
এর মধ্যেই যাদবপুর এলাকায় বাইপাসের দু’ধারে যথেচ্ছ ভাবে তৈরি হয়েছে বহুতল। সবাই নির্ভরশীল ভূগর্ভের জলের উপরে। গভীর নলকূপ নিয়ন্ত্রণ করতে ২০০৫ সালে রাজ্যে একটি আইন হয়। তার তোয়াক্কাই করেনি পুরসভা। শহরেরর বিভিন্ন এলাকায় বছরে জলস্তর কতটা কমছে, কোন এলাকায় কোন কোন বিপজ্জনক মৌল ভূ-জলে মিশে যাচ্ছে তার নিজস্ব কোনও রেকর্ডই নেই পুরসভার। তারা পুরোপুরি নির্ভরশীল কেন্দ্রীয় ভূ-জল নিগমের উপরে। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ওই নিগমের সুপারিশ ছিল, কলকাতায় ভূগর্ভের জলস্তর যে ভাবে নেমে যাচ্ছে তাতে গভীর নলকূপ বসানো অবিলম্বে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এখন যে সব গভীর নলকূপ আছে, ধাপে ধাপে সেগুলি বন্ধ করতে হবে। কোথায় কত গভীর নলকূপ বসানো হল, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পুরসভা একটা সুপারিশও পালন করেনি।
আর সম্প্রতি তারা যা করল তাতে কেন্দ্রীয় ভূ-জল নিগমের গবেষকদের অনেকেই হতবাক। গঙ্গার পরিশোধিত জল বড় একটা এলাকায় এখনও সরবরাহ করতে পারে না পুরসভা। পানীয় জলের জন্য ওই সব এলাকার বাসিন্দাদের ভরসা গভীর নলকূপ। তীব্র গরমে ওই সব এলাকায় পানীয় জলের সঙ্কট দেখা দেওয়ায় পুরসভা ফের সেখানে গভীর নলকূপ খোঁড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত যে বিজ্ঞানসম্মত নয় তা বোঝাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজের গবেষকেরা যাদবপুর-টালিগঞ্জ এলাকার ছয়টি (তার পাঁচটি পুরসভার) গভীর নলকূপের জল পরীক্ষা করেছিলেন। প্রতিটি নলকূপের জলের নমুনাতেই বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক পেয়েছিলেন ওই সমীক্ষকরা। তাঁরা ভেবেছিলেন, সেই সমীক্ষা রিপোর্ট দেখে গভীর নলকূপ বসানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করবে পুরসভা।
১৯৯৩, ২০০০ সালের পরে এবার ২০১২। ফের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা রিপোর্টকে আমলই ছিল না পুরসভা। বোঝা গেল ‘পরিবর্তন’-এর রাজ্যে কলকাতা পুরসভার রয়েছে আগের জায়গাতেই। আর এর মধ্যে রাজ্য সরকার শিথিল করল ভূগর্ভের জল উত্তোলন বিধি। ওই বিধিতে ভূগর্ভের জল তুলতে গেলে আগাম অনুমতি নিতে হত পুরসভা বা পঞ্চায়েতের। কৃষিকাজে পাম্প ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের জন্য দিতে হত মোটা মাসুল। বিধি শিথিল করে সেই বাধ্যবাধকতাগুলিই তুলে দিল নতুন সরকার। এর ফলে যা হওয়ার সেটাই হল।
শুধু আর্সেনিক নয়, জল বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা এই বিধি শিথিলের ফলে রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকায় বাড়বে ফ্লুওরাইডের সমস্যাও। রাজ্য সরকার ভূগর্ভের জল উত্তোলনের বিধি শিথিল করায় যে কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মাটি ধসে পড়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞেরা। ভূ-বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, মাটির তলা থেকে যত বেশি জল তোলা হবে, মাটির উপরের স্তরের স্থিতাবস্থা তত তাড়াতাড়ি নষ্ট হবে। ফলে খুব অল্প তীব্রতার ভূমিকম্প কিংবা সামান্য বন্যায় সহজেই মাটি ধসে পড়তে পারে।
খড়্গপুর আইআইটি’র ভূ-বিজ্ঞানী শঙ্করকুমার নাথ মনে করছেন, পশ্চিমবঙ্গে ভূগর্ভস্থ জলের অবস্থা খুবই খারাপ। মাটির একেবারে উপরের স্তর এমনিতেই খুব নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।“ উপরের স্তরের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় যে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগেই মাটি বসে যাওয়ার আশঙ্কা। এর পরে আরও জল তোলা হলে মৃদু ভূমিকম্পেই ঘরবাড়ি-সহ মাটি ধসে পড়তে পারে। বন্যার সময়ে যেখানে-সেখানে ফাটল ধরে জমি বসে যেতে পারে। ভূমিক্ষয়েরও আশঙ্কা প্রভূত।” বলেন শঙ্করবাবু।
জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ভূ-তাত্ত্বিক তারকনাথ পালের মন্তব্য, “ভূগর্ভ থেকে বেশি জল তুলে নিলে মাটির নীচের ভারসাম্যটাই নষ্ট হয়ে যাবে। আর্সেনিক-ফ্লুওরাইড-লোহার মতো মৌল আরও বেশি বেশি করে জলে মিশবে। ভূগর্ভের জল আরও দূষিত হয়ে পড়বে।”
নলকূপে বলবৎ থাকা নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করার মধ্যে অশনি সঙ্কেত দেখছেন রাজ্য আর্সেনিক ও ফ্লুওরাইড টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান কুমারজ্যোতি নাথও। যাঁর দাবি, “এ ভাবে ঢালাও পাম্প বসানোর অনুমতি দেওয়াটা কেন্দ্র ও রাজ্যের সংশ্লিষ্ট আইনের সম্পূর্ণ বিরোধী। প্রধানত ভূগর্ভের জল বাঁচাতেই ওই আইন তৈরি হয়েছিল। ভূগর্ভের জল ইতিমধ্যে ব্যাপক ভাবে সেচের কাজে ব্যবহার করায় আমাদের খাদ্য-শৃঙ্খলে আর্সেনিকের ছোঁয়া লেগেছে। এখন চাষিদের ঢালাও জল তোলার অনুমতি দেওয়া হলে অদূর ভবিষ্যতে মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হবে।”
কুমারজ্যোতিবাবুর প্রশ্ন, “ভূগর্ভের জল তোলা নিয়ে জেলায় জেলায় তো নিয়ন্ত্রণ কমিটি হয়েছে! তাদের তা হলে রাখার দরকার কী?”
ভূ-বিজ্ঞানী কিংবা আর্সেনিক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যানের এই সব আশঙ্কাকে অবশ্য আমল দিচ্ছেন না রাজ্যের ক্ষুদ্রসেচ দফতরের কর্তারা। ভূগর্ভের জলস্তর নিয়ে ‘বাড়াবাড়ি রকমের’ উদ্বেগেরও কোনও কারণ তাঁরা দেখছেন না। দফতরের পদস্থ এক কর্তার বক্তব্য, “ভূগর্ভের জল সংরক্ষণের নামে রাজ্যের কৃষকদের সেচের জল তুলতে দেওয়া না-হলেও সেই জল পশ্চিমবঙ্গের মাটির নীচে আবদ্ধ হয়ে থাকবে না। তা ভূগর্ভ দিয়েই অন্যত্র বয়ে যাবে। অন্য জায়গার কৃষকেরা তা তুলে নিয়ে বাড়তি শস্য ফলাবেন। অথচ এ রাজ্যের চাষিরা জলের অভাবে মার খাবেন।” পশ্চিমবঙ্গে চাষের জমি এত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে বিভক্ত যে, অধিকাংশ কৃষকের বিদ্যুৎচালিত ছোট পাম্পসেট বসালেই চলবে বলে দাবি করেন ওই ক্ষুদ্রসেচ-কর্তা।
পাশাপাশি দফতরের কর্তাদের এ-ও দাবি: পঞ্জাব-হরিয়ানার মতো রাজ্য ভূগর্ভ থেকে অনেক বেশি জল তোলে। ওঁদের মতে, ভূগর্ভের যে স্তর পর্যন্ত বর্ষার জল নতুন ভাবে প্রাকৃতিক উপায়ে সঞ্চিত হয়, চাষের কাজে তার পরিকল্পিত ব্যবহার জরুরি। কারণ, বর্ষার আগে জলস্তর নেমে গেলেও বর্ষার পরে তা আবার আগেকার জায়গায় ফিরে আসে। এক কর্তার কথায়, “আমরা গত দশ বছরে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বর্ষার আগে-পরের ভূগর্ভস্থ জলস্তরের অবস্থা খতিয়ে দেখেছি। তার ভিত্তিতে নিরাপদ সীমা বজায় রেখে চাষের কাজে জল ব্যবহার করতে দেওয়ার নতুন সিদ্ধান্ত হয়েছে। অতিরিক্ত সাবধানতা যাতে রাজ্যের কৃষি উৎপাদনকে ব্যাহত না-করে, তা সুনিশ্চিত করা হয়েছে।”
এই সংক্রান্ত আরও খবর...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy