স্মরণীয়: চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার বিক্রমের অবতরণ-মূহুর্তের সাক্ষী শহরের পড়ুয়ারা। বুধবার, সায়েন্স সিটিতে। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য।
২০০ মিটার। ১০০ মিটার। ৫০ মিটার।
ল্যান্ডার বিক্রমের সঙ্গে চন্দ্রপৃষ্ঠের দূরত্ব যত কমছে, উত্তেজনার পারদও ততই বাড়ছে ‘বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজ়িয়াম’ (বিআইটিএম)-এর হলঘরে। যেন ভারত-পাকিস্তান টি-টোয়েন্টি ম্যাচের শেষ ওভার অথবা ফুটবলের পেনাল্টি শুট আউটের থেকেও বেশি রুদ্ধশ্বাস অবস্থা। সরাসরি সম্প্রচার দেখতে বিআইটিএমে আসা সকলেই যেন দম চেপে বসে। ভারতীয় সময় ঠিক ৬টা ৪ মিনিটে বিক্রম চাঁদের মাটি ছুঁতেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল গোটা হলঘর। ঘরের ডান দিকে বসে থাকা একদল পড়ুয়ার ‘থ্রি চিয়ার্স ফর বিক্রম, থ্রি চিয়ার্স ফর ইন্ডিয়া’, ‘মেরা ভারত মহান’ চিৎকারে যেন গর্জে উঠল বিআইটিএমের অডিটোরিয়াম। তখন কেউ প্রাণপণে ওড়াচ্ছেন জাতীয় পতাকা, চোখে জল নিয়ে কেউ জড়িয়ে ধরছেন পাশের জনকে। কেউ আবার সঙ্গে করে আনা সন্তানকে বোঝাতে ব্যস্ত এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের মহিমা।
চন্দ্রযানের চন্দ্রস্পর্শের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী থাকতে বুধবার বিকেলে বিআইটিএমে এসেছিলেন নৈহাটির পলাশ দাশ। জাতীয় পতাকা ওড়াতে ওড়াতে বললেন, ‘‘গত বার একটুর জন্য সাফল্য আসেনি। এখানেই দেখতে এসেছিলাম। খুব মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরি। এ বার আসার সময়ে জেদ চেপে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আমাদের বিজ্ঞানীরা করে দেখালেন। এর থেকে বড় গর্বের মুহূর্ত আর কী-ই বা হতে পারে!’’ বিআইটিএমের এডুকেশন অফিসার তরুণ দাস সম্প্রচার শুরুর আগে দর্শকদের বোঝাচ্ছিলেন, কী ভাবে বিক্রম চাঁদের মাটি স্পর্শ করবে। বার বার বলছিলেন, এ বার সাফল্য আসবেই। ইতিহাস রচিত হওয়ার পরে তিনিই উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘‘অভূতপূর্ব এই সাফল্য। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এর পরে পর পর আরও কী কী সাফল্য আনবে ইসরো, সেটা দেখবেন।’’ বলতে বলতে আবেগে গলা ধরে এল তাঁর। টালিগঞ্জ থেকে আসা রাকেশ চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘বিক্রম যখন ৫০ মিটার দূরে ছিল, তখন শুধু ভাবছিলাম, চাঁদ তো একটা ফুটবল মাঠের আয়তনের থেকেও কম দূরত্বে রয়েছে। এ বার নিশ্চয়ই হবে। যখন চাঁদের মাটি ছুঁল, তখন সেই আনন্দ ক্রিকেটে শেষ বলে ছয় মেরে জেতার মতোই।’’
দক্ষিণ কলকাতার রামমোহন মিশন স্কুলের পড়ুয়ারা এ দিন সারা দুপুর ধরে চন্দ্রযান ৩-এর মডেল তৈরি করে। বিকেল সাড়ে ৫টা বাজতে না বাজতেই তাদের সকলের চোখ স্কুলের অডিটোরিয়ামের বড় পর্দার দিকে। যেখানে বিক্রমের চন্দ্রাভিযানের সরাসরি সম্প্রচার দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। চাঁদের মাটি ছোঁয়ার সেই ইতিহাস তৈরি হতেই দু’হাত তুলে আনন্দ করতে থাকে পড়ুয়ারা। একাদশ শ্রেণির কয়েক জন পড়ুয়া বলে, ‘‘আমাদের স্কুলজীবনের এটাই সব থেকে স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে থাকবে। এর থেকে গর্বের আর কী হতে পারে।’’ পাশে দাঁড়ানো আর এক পড়ুয়া বলল, ‘‘বিশ্বকাপে ভারত জিতলেও এত আনন্দ হয় না।’’ স্কুলের অধ্যক্ষ সুজয় বিশ্বাস বললেন, ‘‘এ রকম একটা সফল অভিযান পড়ুয়াদের বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চশিক্ষার বিষয়ে অনেক বেশি উৎসাহিত করে। এই অভিযান সকলের কাছে একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল। এমন গর্বের মুহূর্ত আমার শিক্ষকজীবনে খুব কম এসেছে।’’
ইসরোর সাফল্যে গর্ব কিছু কম হচ্ছে না নিউ টাউনের প্রবীণ দম্পতি দেবদাস চট্টোপাধ্যায় ও নন্দিতা চট্টোপাধ্যায়েরও। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে বিক্রমের সফল অবতরণের সম্প্রচার টিভিতে দেখেই হাততালি দিয়ে উৎকণ্ঠা ঝেড়ে ফেললেন তাঁরা। এক মাস ১০ দিনের প্রতীক্ষার অবসান হল তাঁদেরও। কারণ, তাঁদের ছেলে সৌম্যজিৎ চট্টোপাধ্যায় ইসরোয় মিশন-অধিকর্তা। সফ্টওয়্যার অপারেশন বিভাগ থেকে চন্দ্রযান ৩-কে চাঁদের বুকে নামাতে গত ৩০-৪০ দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তিনিও। বিজ্ঞানীদের মতো এ দিন সৌম্যজিতের প্রত্যাশাও পূরণ হয়েছে। নিউ টাউনের সিই-২৩ নম্বর বাড়িতে বসে দেবদাস বললেন, ‘‘দুপুরে ছেলে তিন মিনিটের জন্য ফোন করেছিল। তখন ওরা ভীষণ ব্যস্ত ছিল। যদিও চন্দ্রযান ৩ নিয়ে ইসরো শুরু থেকেই আত্মবিশ্বাসী ছিল। তবুও যত ক্ষণ না স্পর্শ করছে, তত ক্ষণ উৎকণ্ঠা ছিলই।’’ ২০০৭-এ ইসরোয় যোগ দেন সৌম্যজিৎ। মা নন্দিতা জানান, চন্দ্রযান ১ ও ২— দু’টি প্রকল্পের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন তাঁদের ছেলে। সারা দেশের মতো এ দিন সকাল থেকে চন্দ্রযানের জন্য প্রার্থনা করে চলেছিলেন তাঁরাও। নন্দিতার কথায়, ‘‘ছোটবেলায় আকাশভরা তারা দেখে আমার কাছে তারাদের নাম জানতে চাইত। আজ ছেলের জীবনেও বড় সাফল্যের দিন। ওর ফোনের অপেক্ষা করছি। ওর খুশি মাখা গলাটা এক বার শুনতে চাই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy