Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

পার্থকে বাড়তি সুবিধা কেন, ক্ষোভ পাভলভে

এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন? প্রশ্ন তুলে আমরণ অনশনের হুমকি দিয়েছেন পাভলভ মানসিক হাসপাতালের অন্য রোগীরা। কারণ পছন্দসই খাবার, কেনা জল থেকে নিত্য ব্যবহার্য টুকিটাকি, এমনকী একার জন্য নতুন ফ্যান— যখন যা চাইছেন, পেয়ে যাচ্ছেন রবিনসন স্ট্রিটের কঙ্কাল-কাণ্ডের পার্থ দে। যার কোনওটাই তাঁদের বরাতে জোটে না বলে অভিযোগ অন্য রোগীদের।

পাভলভের আবাসিকদের সঙ্গে পার্থ দে। মঙ্গলবার। ছবি: শৌভিক দে।

পাভলভের আবাসিকদের সঙ্গে পার্থ দে। মঙ্গলবার। ছবি: শৌভিক দে।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৫ ০২:৩০
Share: Save:

এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন?

প্রশ্ন তুলে আমরণ অনশনের হুমকি দিয়েছেন পাভলভ মানসিক হাসপাতালের অন্য রোগীরা।

কারণ পছন্দসই খাবার, কেনা জল থেকে নিত্য ব্যবহার্য টুকিটাকি, এমনকী একার জন্য নতুন ফ্যান— যখন যা চাইছেন, পেয়ে যাচ্ছেন রবিনসন স্ট্রিটের কঙ্কাল-কাণ্ডের পার্থ দে। যার কোনওটাই তাঁদের বরাতে জোটে না বলে অভিযোগ অন্য রোগীদের।

এ নিয়ে কিছু বলতে রাজি নন খোদ পাভলভের সুপার গণেশ প্রসাদ। পার্থবাবুকে এমন বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দিতে পুলিশ বা স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশ যে নেই, তা মানছেন তিনি। অতীতে কোনও রোগীর এমন আবদার মেটানো হয়েছে বলে মনে নেই, জানাচ্ছেন তা-ও। তা হলে কেন এই বৈষম্য? সুপারের জবাব, ‘‘আমার কিছু জানা নেই।’’ তা হলে জানার কথা কার? সদুত্তর মেলেনি।

গোড়ায় ওয়ার্ডে অন্যদের সঙ্গে থাকলেও পরে পার্থবাবু কিছুটা ‘প্রাইভেসি’র দাবি তোলেন। তা মেনে ওয়ার্ডেই একচিলতে আলাদা ঘরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়। রবিবার সকাল থেকেই পার্থবাবু বলতে শুরু করেন, ‘‘আমার এসি ঘরে থাকা অভ্যাস। খুব গরম লাগছে। ভাল পাখার ব্যবস্থা করুন।’’ সোমবার বিকেলে নামী ব্র্যান্ডের নতুন পাখা আসে সেই ‘প্রাইভেট’ ঘরে। এর পরেই জোর হল্লা শুরু করেন মেল ওয়ার্ডের অন্য রোগীরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে নাজেহাল হন হাসপাতাল কর্মীরা।

সাধারণ ভাবে মানসিক হাসপাতালের ওয়ার্ডে রোগীদের নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে জালে ঢাকা সিলিং ফ্যান লাগানো থাকে। তাতে হাওয়া অনেকটাই কম পৌঁছয়। গরমে রোগীরা অস্থির হলেও কর্তৃপক্ষের একটাই বক্তব্য, ‘‘এটাই নিয়ম।’’ পার্থবাবুর জন্য এই বাড়তি আরামের ব্যবস্থা নিয়ে তাই ক্ষোভ থামেনি মঙ্গলবারও। সকালে রাউন্ড দিতে আসা এক ডাক্তারকে এক রোগী বলেন, ‘‘কঙ্কালের সঙ্গে এক ঘরে থাকিনি বলেই আমরা কোনও সুযোগ-সুবিধা পাব না? তা হলে কঙ্কাল এনে দিন, আমরাও পাশে নিয়ে ঘুমোব। তাতে অন্তত পেট ভরে খাওয়া জুটবে।’’ সমস্বরে পাভলভের মেল ওয়ার্ডের রোগীরা জানিয়ে দিয়েছেন, এই বৈষম্য তাঁরা বরদাস্ত করবেন না। একই ওয়ার্ডে থেকেও কেন পার্থ দে নানা ধরনের বাড়তি সুযোগসুবিধা পাবেন, সেই প্রশ্ন তো তাঁরা তুলেছেনই। হুমকি দিয়েছেন আমরণ অনশনেরও।

‘বৈষম্য’ নিয়ে ক্ষোভ শুরু হয় প্রথম দিনই। প্রথম রাতে ভাত খেতে আপত্তি করেছিলেন পার্থ। জানিয়েছিলেন, রাতে রুটি খাওয়াটা তাঁর বহু বছরের অভ্যাস। সেটা তিনি বদলাবেন না। হুকুম মতো গরম গরম চারটে রুটি-সব্জি দেওয়া হয় তাঁকে। তা দেখেই চক্ষু চড়কগাছ অন্য রোগীদের। তাঁদের থালায় তখন শক্ত হয়ে যাওয়া ঠান্ডা ভাত। রাতের পথ্যে বারবার চেয়েও যে রুটি তাঁরা পাননি, এক বার বলেই পার্থবাবুর বরাতে তা জুটে যাওয়ায় তাঁরা শুধু ক্ষুব্ধ নন, বিরক্তও হন। কিন্তু সে কথায় কেউ কান দেননি।

দ্বিতীয় দিন প্রাতরাশে ডিমসেদ্ধ দেওয়া হয়। পার্থবাবু ওমলেট খাওয়ার বায়না জোড়েন। ডিউটিতে থাকা নার্স তখন বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সেদ্ধ ডিম খেতে রাজি করান। তবে রাতেই তাঁর আবদার মতো ওমলেট বানিয়ে দেওয়া হয়।

এক বার বলেই নামী ব্র্যান্ডের সাবান, দামি টুথপেস্ট-ব্রাশ, টিস্যু পেপার, কাঁটা-চামচ সবই পেয়েছেন পার্থবাবু। যেখানে অন্য রোগীরা শৌচাগার থেকে জল নিয়ে পান করতে বাধ্য হন, সেখানে তাঁর জন্য এসেছে মিনারেল ওয়াটার। স্টিলের বদলে কাচের বাসনে খেতে চেয়েছিলেন তিনি। তা-ও ভেবে দেখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

মঙ্গলবার সকালে সেই প্রসঙ্গ তুলে এক রোগী বলেন, ‘‘খাবারের মান নিয়ে বহু বার অভিযোগ করেছি। পোকা ধরা চালের ভাত, আধ সেদ্ধ সব্জি, কাঁটায় ভর্তি ছোট্ট এক টুকরো মাছ নিয়েও কত বার বলেছি। কেউ শোনেনি। আর উনি এক বার বলতেই সব হয়ে যাচ্ছে। এটা বরদাস্ত করা যায় না।’’

বস্তুত, পার্থ দে-র জন্য এমন ভিআইপি ট্রিটমেন্টে ক্ষুব্ধ পাভলভের চিকিৎসকদের একাংশও। এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘মনোরোগীরা যে ওষুধ খান, তার জন্য চাই ভাল পথ্য। খাবারের বরাদ্দ কিছুটা বাড়লেও মান এখনও তেমন উন্নত হয়নি। কই তা নিয়ে তো কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথা নেই!’’

পাভলভের মনোরোগীদের নিয়ে কাজ করা এক সংগঠনের কর্ণধার রত্নাবলী রায়েরও প্রশ্ন, ‘‘যে যত্ন, যে নজরদারি পার্থবাবুর জন্য করা হচ্ছে, তার কণামাত্র অন্য রোগীরা পেলে মানসিক হাসপাতালের চেনা ছবিটাই বদলে যেত। পাখাই হোক বা ডিমের ওমলেট কিংবা পানীয় জল, এই বৈষম্য মেনে নেওয়া খুব কঠিন।’’

হাসপাতালের এক কর্তা বলেন, ‘‘আমাদেরও হাত-পা বাঁধা। উনি যা চাইছেন, তা না পেলে অনর্থ বাধাচ্ছেন। সেটা যাতে না হয়, উনি যাতে ডাক্তারদের সঙ্গে সহযোগিতা করেন, তাই এ সব করছি।’’

কর্তৃপক্ষের এই মনোভাব জেনে মেল ওয়ার্ডে গত পাঁচ বছর থাকা এক রোগীর মন্তব্য, ‘‘কর্তৃপক্ষ তা হলে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, সোজা আঙুলে কখনওই ঘি উঠবে না। আমরাও তা হলে সে পথেই যাওয়ার কথা ভাবব।’’

মেল ওয়ার্ডের এক নার্স এ দিন বলেন, ‘‘পার্থবাবু যখন যা খুশি বায়না করছেন। মিউজিক সিস্টেম চেয়েছিলেন। না পেয়ে আজ যাচ্ছেতাই চেঁচামেচি করলেন। বললেন, অন্তত একটা আইপড চাই-ই। এ সব দেখে অন্য এক রোগী বললেন, ‘ওঁকে আইপড দিলে আমাকেও মদের বোতল দিতে হবে।’ ব্যাপারটা হাস্যকর পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছচ্ছে।’’

মঙ্গলবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয় পুলিশের। নিজেদের পরিচয় না দিয়ে আজ, বুধবার মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যদের উপস্থিতিতে পার্থবাবুর সঙ্গে কথা বলবে সাদা পোশাকের পুলিশ। থাকবেন মহিলা পুলিশও। সেই সঙ্গেই এক-এক দফায় পার্থবাবুকে অল্প সময়ের জন্য জেরা করা হবে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE