আশ্রয়: চাচার সঙ্গে ফুটপাথের আত্মীয়েরা। —নিজস্ব চিত্র।
নিকট আত্মীয়েরা কে কোথায় আছেন, তা তাঁর জানা নেই। দেশ কোথায় জানতে চাইলে ঘোলাটে চোখ তুলে কখনও বলেন মুঙ্গের, কখনও ঝাঝা, কখনও বারাবনি। গত বহু বছর পাশের সেই রাজ্যে পা রাখেননি তিনি।
ময়দান মার্কেট ঘিরে থাকা এক দল মুটে-মজুরই এখন তাঁর পরমাত্মীয়। বছর চারেক হল তাঁদের সঙ্গে আলাপ অশীতিপর মহম্মদ আরমানের। তাঁরাই খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এমনকী, নেশার খৈনিটাও তাঁরাই জোগাড় করে দেন। এ ভাবেই ‘বুড়ওয়া চাচা’র উপরে কেমন একটা মায়া পড়ে গিয়েছে মহম্মদ আবদুল, রামদেও সাউ, মহম্মদ দাউদদের।
মাস আটেক আগে এক দিন পুলিশ এসে ময়দান মার্কেটের পিছনে বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া ভাতের হোটেলে এসে খবর পৌঁছে দিয়ে চলে যায়— গাড়ি ধাক্কা মেরেছে আরমানকে। তাঁকে আহত অবস্থায় এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মুষড়ে পড়েন আবদুলরা। দিন গুনতে থাকেন, কবে চাচা সুস্থ হয়ে ফিরবেন।
আপনারা হাসপাতালে দেখতে যাননি?
আবদুলের কথায়, ‘‘ইতনা বড়া হাসপাতাল। হাম মজদুর লোগ। কাঁহা ঢুন্ডতা ফিরতা?’’ তবে, মাস দুয়েক পরেও আরমান না ফেরায় এক বার রামদেও, দাউদরা হাসপাতালে গিয়েছিলেন চাচার খোঁজে।
কিন্তু বিশাল হাসপাতালে ঢুকে সত্যিই খেই হারিয়ে যায় তাঁদের। হাসপাতালের কর্মীরা জানতে চান, চাচা কোন বিল্ডিং-এ, কোন ওয়ার্ডে ভর্তি? ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না তাঁদের। ফিরে আসেন।
তার পরেও মাস দুই কেটে গেলে বুঝে যান, চাচা আর ফিরবেন না। ‘‘মর গিয়া হোগা চাচা’’ ভেবে দিনমজুরেরা চোখের জল মুছে লেগে পড়েন যে যার কাজে। রামদেওর কথায়, ‘‘শোক করার সময় কোথায় আমাদের? যে দিন কাজ করব না, সে দিন রুটিও জুটবে না।’’ শুধু ময়দান মার্কেটের পিছনের গেটের এক পাশে চাচার জন্য বানিয়ে দেওয়া প্লাস্টিকের ছাউনির দিকে চোখ গেলে মুচড়ে উঠত মনটা।
এ ভাবেই আট আটটা মাস কেটে গিয়েছিল। আচমকাই দিন দুয়েক আগে একটা হলুদ ট্যাক্সি এসে দাঁড়ায় ময়দান মার্কেটের ওই গেটে। এক যুবক ধরে ধরে নামিয়ে আনেন আরমানকে। চাচাকে ফিরে পেয়ে কেঁদে ফেলেন আবদুলরা। ধরেই তো নিয়েছিলেন, মারা গিয়েছেন চাচা। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, গাড়ির ধাক্কায় জখম হয়ে আট মাস হাসপাতালে ছিলেন তিনি। শেষের দিকে সুস্থ হয়ে গেলেও কে এসে তাঁকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবেন, তার হদিস পায়নি হাসপাতাল। দুর্ঘটনার পর থেকে চুপ মেরে গিয়েছিলেন আরমান। কথাবার্তাতেও কিছু অসংলগ্নতা ছিল। তাঁর সঙ্গে দিনের পর দিন কথা বলে জানা যায় ময়দান মার্কেটের মজুরদের কথা। হাসপাতালের শয্যা খালি করারও তাগিদ ছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই তাঁকে ওই ফুটপাথে ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগী হন।
কোথায় তাঁর আত্মীয়েরা?
আবদুল বলেন, ‘‘চাচা আগে গ্র্যান্ড হোটেলের পাশে একটি বার-এ কাজ করতেন। তার পরে বয়সের ভারে কাজ ছেড়ে দেন। আমাদের সঙ্গে সেই থেকেই যোগাযোগ। বলেছিলেন টিটাগড়ে শ্যালিকা থাকেন। তাঁর বাড়িতে দু’এক দিনের জন্য যেতেন। তা-ও বন্ধ বছর পাঁচেক হল।’’ কথা বলে জানা গিয়েছে, তাঁর ছেলে, নাতি রয়েছে। কিন্তু, তাঁদের কখনওই ময়দান মার্কেটের ত্রিসীমানায় দেখা যায়নি।
ঘোলাটে চোখ তুলে ভাঙা গলায় চাচা বলেন, ‘‘এরাই আমার আত্মীয়। আমার আর কেউ নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy